Sunday,8,December,2024
19 C
Dhaka
Sunday, December 8, 2024
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতসরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তে "ব্যবসায়িক স্বার্থ"…

সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তে “ব্যবসায়িক স্বার্থ”…

।। খান আসাদ ।।

“ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় বেক্সিমকোর চাপের কারণেই সরকার টিকার বিকল্প উৎসে যেতে পারেনি, যদিও রাশিয়া ও চীন বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করতে চেয়েছিল।” পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য হিসেবে এটি ফেসবুকে সবাই দেখেছেন মনে হয়। সরকারি সিদ্ধান্তে “ব্যবসায়িক স্বার্থ” থাকে, তিনি না বললেও।
বাংলাদেশে সরকারী সিদ্ধান্ত কারা নির্ধারণ করে? কিভাবে নির্ধারিত হয়?
উপরের এই প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি “বেক্সিমকোর টিকা ব্যবসা” কেসস্টাডি থেকে বোঝা সহজ হবে। বাংলাদেশে, অনেক শিক্ষিত লোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক, এমপি মন্ত্রী হয়েছে বা হবে, এরকম লোকেরা একটি মিথ বা মিথ্যে কথা চালু রেখেছে। সেটি হচ্ছে, যে কোন সরকারী সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ব্যাক্তির ইচ্ছায়। প্রধান মন্ত্রীর ইচ্ছায়। অথবা তাঁর ছেলের ইচ্ছায়, কোন “ভবন” থেকে।
এই মিথ বা মিথ্যে কথার একটি শ্রেণীচরিত্র ও দার্শনিক ভিত্তি আছে। প্রথম সমস্যা, এরা একটি ধর্মান্ধ সমাজে বাস করে, ফলে এদের এমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা আবেগবুদ্ধি ঈশ্বর ধারনা প্রভাবিত। এদের ধারনা, দোজাহানের মালিক আল্লা, একই ভাবে রাষ্ট্রের মালিক প্রধানমন্ত্রী। দেশে যাই হোক, সেটা প্রধানমন্ত্রীর কাজ। অথবা, পাশের দেশে, সব কিছুর জন্য মমতা ব্যানার্জি দায়ী। মোদী ডাকে দিদিরে।
দ্বিতীয় সমস্যা এদের রাজনীতির ইতিহাস শিক্ষা। ইতিহাসে এরা শিখেছে ব্যক্তির গুণগান। ব্যক্তি বাদশাহ আকবর কিংবা সুলতানা রাজিয়ার ইতিহাস ছিল পাঠ্য পুস্তকে। এই শিক্ষা থেকে রাজনীতির বিশ্লেষণ নির্ধারিত হয়। স্বৈরাচার এরশাদ, খালেদা জিয়া, বা শেখ হাসিনা “ভিলেন” হিসেবে প্রচারিত হয়। দাবী করা হয়, ক্ষমতা থেকে ব্যক্তিদের অপসারণের। আড়াল করা হয় গোটা রাষ্ট্র ও প্রশাসন ব্যবস্থা, শ্রেণী শাসন। এটিই হচ্ছে এই ধরনের রেজিম চেঞ্জ রাজনীতির শ্রেণীচরিত্র। ব্যক্তিকে বদলে দাও, শ্রেণীশোষণমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখো। এই যে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে দাও সংবিধান সংশোধন করে, রাষ্ট্রচিন্তার প্রেসক্রিপশনের মুলেও ঐ একই চিন্তা, ব্যক্তির ক্ষমতা সংকোচন।
দুটো প্রশ্ন করুন। কারা সরকারী সিদ্ধান্ত নেয়? কি প্রক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়? করোনা ভ্যাক্সিন পাওয়া নিয়ে সরকারী সিদ্ধান্ত বেক্সিমকো কিভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটা বুঝতে হলে, উপরের দুই প্রশ্নের উত্তর বোঝা জরুরী।
সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্ত নেয়, অনেক লোক মিলে। সামরিক বেসামরিক আমলা নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সরকারের শীর্ষ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা, সরকারের উপদেষ্টা যারা আবার বাইরের মুরুব্বীদের সাথে সম্পর্কিত, পেশাদার বিশেষজ্ঞ ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়ী লবি। বাংলাদেশে আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, গার্মেন্টসসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠন।
কোন ব্যক্তি নেতা পলিসি ও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। সে যত বড় ক্যারিসম্যাটিক, বুদ্ধিমান, সবজান্তা, অঙ্গুলি হেলনে কর্মী নাচানো মহামানব হোক না কেন। তাঁকে একটি সিস্টেমে কাজ করতে হয়। যেই সিস্টেমে অনেক লোকের ভূমিকা থাকে। এই সব লোকেদের জ্ঞান, পেশাদারিত্ব, শ্রেণীস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, ইত্যাদির মিথস্ক্রিয়ায় পলিসি ও সিদ্ধান্ত তৈরি হয়।
সিদ্ধান্ত তৈরি হয়, ধাপে ধাপে। একটি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথমে এজেন্ডা সেট করা হয়। অনেক সময় সেই এজেন্ডা জনপ্রিয় করে সংবাদপত্র, বা সম্পাদকেরা। সেই এজেন্ডা নিয়ে চাপান-উতোর চলে, নিজেদের ভেতরে জোট হয়, কখনো ঘুষ দিয়ে কখনো চাপ দিয়ে নিজের দলে নেয়া হয়।
ফলে, কওমি জননী কেন তেঁতুল হুজুরের কাছে গেল? এই “কেন গেল” বুঝতে হলে সরকারী নীতি ও সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া বুঝতে হয়। আপনি ভাবলেন, আপনি কওমি জননীর চেয়ে বুদ্ধিমান এবং তাঁকে ফেবুতে জ্ঞান দিয়ে সেক্যুলার লাইনে আনবেন, আপনি আসলে একজন *** মানুষ। বাংলাদেশে যা হচ্ছে, সরকারীভাবে তা একটি রাষ্ট্র ও প্রশাসন ব্যবস্থার পলিসি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় হচ্ছে, যেখানে আমলাতন্ত্র, “বিশেষজ্ঞ” ও ব্যবসায়ি সিন্ডিকেটের ভূমিকা অনেক রাজনীতিবিদদের চেয়ে অনেক বেশি।
তাহলে কি করবেন? ধরুন, করোনার টিকা নিয়ে গণবিরোধী কাজের জন্য কাকে ধরবেন? মন্ত্রীর বা সরকারের পদত্যাগ চাইবেন? না কি বেক্সিমকো জাতীয়করনের কথা বলবেন?
আপনি কি করবেন জানিনা। কিন্তু আমি এই রাষ্ট্র ও প্রশাসন ব্যবস্থার চরিত্র উন্মোচন করবো। এর দায় যাদের যাদের আছে, তাঁদের প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করবো। মুল যে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ননীতি, মেগাপ্রকল্পের ও লুটেরা পুঁজিপতি তৈরির উন্নয়ননীতির গণবিরোধী শ্রেণীচরিত্রের কথা বলবো। এই ব্যবস্থার বিকল্প বলবো, এবং এই ব্যবস্থা বদলের কথা বলবো।
হ্যাঁ, সুনির্দিষ্টভাবেও বলতে হবে। যেমন বেক্সিমকোর ভূমিকা, যেমন আলম গ্রুপের ভূমিকা, যেমন গার্মেন্টস মালিকদের ভূমিকা। কারণ, জনসমক্ষে যতই এদের গণবিরোধী, দেশবিরোধী ভূমিকা উন্মোচিত হবে, ততোই এদের সরকারী সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখার ক্ষমতা কমবে। ততোই রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার মধ্যে যে দেশপ্রেমিক অংশ আছে, তারা ক্ষমতাবান হবে। এরা ক্ষমতাবান হলে, অনেক সিদ্ধান্ত হবে পেশাদারিত্বের সাথে, জনগণের স্বার্থে।
আমরা একটি বৈষম্য ও সহিংস ব্যবস্থার মধ্যে আছি। আমরা একটি সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মধ্যে আছি। সমূলে এই ব্যবস্থাটিকে বদলাতে হবে। এজন্য ১৯৭১ এর অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রেরণা।
 
লেখকঃ খান আসাদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ