।। ড. সুশান্ত দাস।।
সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ’ বনাঞ্চল। এই প্রাকৃতিক বন গাছপালা ও জীববৈচিত্রে ভরপুর। জীববিজ্ঞানীদের মতে (কিছু মতান্তর থাকতে পারে) এই বনে প্রায় ৩৩০ প্রকারের গাছ, ২ শতাধিক প্রজাতির মাছ, ৪২ ধরণের স্তন্যপায়ী জীব, ২৭০ ধরণের পাখী, ৫১ ধরণের সরীসৃপ, ৪ ধরণের উভচর প্রানী এবং অসংখ্য অমেরুদন্ডী জীব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-পৃথিবীখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ ও চিত্রা হরিণ যা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচিতি বহন করে। এই জাতীয় সম্পদ বা জাতীয় গর্ব সুন্দরবনের পরিবেশ তথা সুন্দরবন রক্ষার প্রশ্নে কারুরই দ্বিমত থাকার কথা নয়, অন্ততঃ প্রকাশ্যে তা নেইও। তবে সুন্দরবন রক্ষার পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে, এ সত্য স্বীকার করতে হবে। বিগত শতাধিক বছর ধরেই নানাবিধ কার্যকলাপ সুন্দরবনকে সংকুচিত করে ফেলেছে। কি কি কার্যকলাপ এর জন্য দায়ী সেগুলোকে অনুপুঙ্খভাবে সুনির্দিষ্ট করে তাকে প্রতিরোধ না করলে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাবে না। বন দপ্তর, পরিবেশ দপ্তর, নৌপরিবহন দপ্তর সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সমন্বিত বা পরিকল্পিত উদ্যোগ কখনও পরিলক্ষিত হয়নি। কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের ইস্যুতে সুন্দরবন রক্ষার বিষয়টি জোরেশোরে সামনে চলে এসেছে। কিন্তু, দীর্ঘকাল ধরে নীরবে সুন্দরবন ধ্বংসের যে কার্যকলাপ চলেছে, তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কিছু লেখা, কিছু পোস্টার সর্বস্ব সাংবাদিক সম্মেলন ব্যতিরেকে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে পারে এমন কোন আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়টাকে আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেই আজ সামনে এগুতে হবে। এটা আজ সবাইকে জানতে হবে-বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ কতটা পিছিয়ে। শুধু কৃষি আর মাছ ধরার উপর এখানকার জনগনের জীবিকা চলেছে শত শত বছর ধরে। জীবনধারণের এই প্রক্রিয়ায় সুন্দরবন তাদের জীবিকার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।এ এলাকার ৫ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে প্রায় ২৭ শতাংশ কাঠ, গোলপাতা ইত্যাদি সংগ্রহ, প্রায় ৬৯ শতাংশ নির্ভরশীল জলজ সম্পদের উপর, প্রায় ৪ শতাংশ মানুষ অন্যান্য বিভিন্ন ধরণের কাজের উপর নির্ভরশীল। এই বিপুল জনগোষ্ঠী বিকল্প কাজের অভাবে সুন্দরবনের মধ্যে মাছ ধরা, অবৈধভাবে কাঠ, গোলপাতা, হোগলা, মধু প্রভৃতি আহরণ থেকে শুরু করে বাঘ-হরিণসহ বনের পশু-পাখী শিকারের এই কাজ করে চলেছে অব্যাহতভাবে। এখনও আইনের ফাঁক দিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এ প্রক্রিয়া চলছে, থামেনি। ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত মংলা বন্দর এ অঞ্চলের জন্য এক আশির্বাদ হিসেবে মনে করা হয়। তার সত্যতাও আছে। কারণ, এই পোর্টকে (বন্দর) ঘিরেই শুরু হয়েছে নগরায়ন, বিকল্প কর্মসংস্থান। কিন্তু, তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি-তা হয়েছে নির্বিচারে এবং নীরব জবর-দখলের মাধ্যমে। মংলা বন্দরের বর্তমান অবস্থানও সুন্দরবনের ECA (Environmental Critical Area) র মধ্যে। আশির দশকে যে খুলনা-মংলা মহাসড়ক হয়েছে, তা এই জনপদকে দেশের অন্যান্য এলাকার সংগে যুক্ত করেছে। নতুন প্রস্তাবিত রেল লাইন, বিমানবন্দর সবকিছুই এ অঞ্চলকে বহিঃর্বিশ্বের সংগে যুক্ত করবে। নেপাল-ভুটানের সংগে সরাসরি সড়ক ও রেলপথ সংযোগ মংলা বন্দরের বৈদেশিক যোগাযোগ ও গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলবে। এর ফলে তা সুন্দরবনের পরিবেশের উপরও চাপ ফেলবে। এ ছাড়াও মংলা পোর্টের মধ্যে এবং তার আশেপাশে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট কারখানা, এল, পি গ্যাস কারখানা, ই পি জেড, সাইলোসহ অসংখ্য স্থাপনা। মংলা নদী পাড় হয়ে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হয়েছে পিচঢালা পাকারাস্তা। এ সকল রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন যানবাহন চলাচল সুন্দরবনের জিরো-পয়েন্ট পর্যন্ত চলে গেছে। গড়ে উঠেছে বসতি। এই বসতি এলাকা আর সুন্দরবনের সীমার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। আগেই বলা হয়েছে, বিকল্প টেকসই কোন কর্মসংস্থান না থাকায় এই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আজও বনের উপর এবং বনজ সম্পদের উপর অবৈধভাবে নির্ভরশীল। সুন্দরবনকে ঘিরে তৈরী হয়েছে এক নীরব অবৈধ অর্থনীতি। এটা আজ সর্বজনবিদিত যে, যারা বনকে রক্ষা করার জন্য বৈধভাবে নিয়োজিত, তাদের দুর্নীতিও বনকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে। তাছাড়া প্রাকৃতিক পানি সঞ্চালনকে বাধাগ্রস্ত করে চিংড়ি চাষ করায় সুন্দরবনের চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং এর জীববৈচিত্রের সম‚হ ক্ষতি হয়েছে। জোর করে শুধু মুনাফার লোভে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এই চিংড়ি ঘেরের প্রক্রিয়া এ অঞ্চলের জনপদের স্বাভাবিক অর্থনীতি, গৃহপালিত পশু, বনজ পরিবেশ ধ্বংস করেছে।জোর করে জমি দখল করে অনেক বহিরাগতরা যেভাবে চিংড়ি ঘের করেছে, তাতে অনেকক্ষেত্রে এলাকার প্রকৃত অধিবাসীরা উৎখাত হয়ে গেছে। ধানচাষসহ কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ক্ষতি প্রায় অফেরৎযোগ্য (irreversible)। সর্বোপরি, আধুনিকায়ন ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সুন্দরবনের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে নানা ব্যবসায়, শিল্প কারখানা তৈরির উদ্যোগ- যা নিঃসন্দেহে সুন্দরবনের পরিবেশকে সংকটাপন্ন করে তুলছে। সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার সংগে এ এলাকার মানুষের পরিকল্পিত কর্মসংস্থান আজ সময়ের দাবী। পদ্মাসেতু খুলে যাবার সংগে সংগে নগরায়ন আর উন্নয়নের বিপুল অভিঘাত এ এলাকায় চলে আসবে। তাকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে না পারলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা আর এলাকার জনপদের উন্নয়ন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে। বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত চিন্তা দিয়ে এই অভিঘাতকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। প্রয়োজন একটি সমন্বিত পরিকল্পনার। পরিবেশকে সুরক্ষা করে এলাকার উন্নয়ন অব্যাহত রাখার ভারসাম্যপ‚র্ণ পরিকল্পনার বিকল্প নাই। যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর চাপ প্রয়োগ করবেই। তাকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য পরিকল্পিতভাবে পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগও থাকতে হবে। উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শুধুমাত্র পরিবেশ রক্ষার দাবীতে জনপদও রক্ষা পাবে না, পরিবেশও রক্ষা পাবে না। এ এলাকার জনপদের পরিকল্পিত উন্নয়ন উদ্যোগ না থাকলে মানুষ জীবিকার প্রয়োজনেই বিপথে সুন্দরবনকে ধ্বংস করে ফেলবে। সুন্দরবন ধ্বংস হলে গোটা ব-দ্বীপের জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে অসহায় হয়ে পড়বে- এটা বোঝার জন্য খুব গভীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োজন নাই। তাই সুন্দরবন ও তার পরিবেশের ক্ষতিরোধকে প্রাধান্য দিয়েই বিকল্প উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কর্স পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি ও শিক্ষাবিদ