নতুন কথা প্রতিবেদন: মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকীতে জাতিকে শপথ করালেন স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষের এই আয়োজনে এই শপথ অনুষ্ঠান যখন চলছিল, শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন তার বোন, বঙ্গবন্ধুর আরেক মেয়ে শেখ রেহানা। এছাড়াও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, মন্ত্রিসভার সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধিরা সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শপথ গ্রহণ করেন।
সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে আটটি বিভাগীয় শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বস্তরের মানুষ যোগ দেয় এ শপথ অনুষ্ঠানে। বর্ণিল আয়োজনে উপস্থিত সবাইকে সঙ্গী করে শপথবাক্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তা।
“আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষের বিজয় দিবসে দৃপ্ত কণ্ঠে শপথ করছি যে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করব।
“জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে উন্নত-সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তুলব। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।”
বিজয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ প্রতিপাদ্যে দু’দিনের অনুষ্ঠানমালা সাজিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। এ আয়োজনে দেশবাসীর সঙ্গী হয়েছেন রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের সহযোগী প্রতিবেশী ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোবিন্দও।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে মঞ্চে স্বাগত জানান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
শপথমঞ্চে এসে শেখ হাসিনা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে; ৩০ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের প্রতি জানান শ্রদ্ধা; মুক্তিযোদ্ধদের জানান সশ্রদ্ধ সালাম।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঘাতকদের নির্মম বুলেটে নিহত বাবা শেখ মুজিবুর রহমান, মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, আরেক ভাই মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল ও তার স্ত্রী পারভীন জামাল, ছোট ভাই ১০ বছরের শেখ রাসেল, চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জামিল উদ্দিন এবং পুলিশ কর্মকর্তা হাসিবুর রহমানের কথাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি স্মরণ করেন যুবনেতা মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, কৃষকনেতা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সেরনিয়াবত, তার দশ বছরের ছেলে আরিফ, ১৩ বছরের মেয়ে বেবি, চার বছরের নাতি সুকান্ত, ভ্রাতুস্পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সেরনিয়াবত, ভাগ্নে রেন্টুসহ সেদিন নিহত ১৮ জনের কথা। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতকের হাতে নিহত চার জাতীয় নেতা – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধা জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, “গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে গিয়ে যারা জীবন দিয়েছে, তাদেরকেও আমি স্মরণ করি। যারা নির্যাতিত-নিপীড়িত তাদের শ্রদ্ধা জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা অর্জন করি। দীর্ঘ ২৪ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন, বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।”
শপথের আগে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় স্বাধীনতার পথে বাঙালির দীর্ঘ পথ পরিক্রমার ইতিহার তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙালি জাতি পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করবে এটা পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান মেনে নিতে পারেনি। তাই বাঙালিদের ওপর শুরু করে নিপীড়ন-নির্যাতন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের মানুষকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকতে বলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতি জেলা, মহকুমা, থানা, গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ তার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে আক্রমণ করে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে রাতেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা পিলখানার ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে সারা দেশে পাঠানো হয়। ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম পাঠ করেন। এরপর একে একে অন্যান্য নেতারা এই ঘোষণা পাঠ করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রিকাতেও প্রচারিত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, “বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশ মোতাবেক যাঁর যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের পাশে দাঁড়ায় প্রতিবেশী ভারত, রাশিয়াসহ অন্যান্য বন্ধুপ্রতীম দেশ ও সেসব দেশের জনগণ। মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে আমরা পরাজিত করি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের বিজয়।”
জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আসুন আমরা বাংলাদেশের বিজয়ের এই সুবর্ণজয়ন্তীতে এবং মুজিববর্ষে শপথ গ্রহণ করব, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা এবং বিশ্বসভায় উন্নত সমৃদ্ধ বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে চলার জন্য আমরা শপথ নেব।” সবাইকে নিয়ে শপথ পাঠ করে সকল মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। শপথ শেষ করেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক সংগঠন ’সুরের ধারা ও হাল আমলের শিল্পীদের পরিবেশনায় ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম মুজিবর’ গানের মধ্য দিয়ে শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়।