এম এইচ নাহিদ: আজ ১৪ মার্চ। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মহামতি কার্ল মার্ক্স-এর ১৩৮ তম প্রয়াণ দিবস। ১৮৮৩ সালের এই দিনে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তিনি আজো সারা বিশ্বে অমর হয়ে আছেন। তার বিখ্যাত ‘পুঁজি’ তত্ত্ব এখনো কেবল দুনিয়ার কমিউনিস্টরাই চর্চা করেন না, তা পুঁজিবাদীদের শরীরেও কাঁপন ধরায়। “পুজিঁবাদ’ই শেষ কথা”-দাম্ভিকতার সাথে বলা ওই পুঁজিবাদীরাও এখন মার্ক্সবাদ চর্চা করে। অতএব বলতে দ্বিধা নেই ‘মার্ক্সবাদ’-এর মৃত্যু নেই। পুঁজিবাদ নয়, সমাজতন্ত্র’ই মুক্তির পথ।
১৮১৮ সালের ৫ মে রাশিয়ার রাইন অঞ্চলের ত্রিয়ার শহরে এই মহান বিপ্লবীর জন্ম। পেশায় আইনজীবী পিতার সন্তান হিসেবে মার্ক্সও স্কুলের পাঠ শেষে প্রথমে বন, পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। সে পাঠ শেষে তিনি ইতিহাস ও দর্শনে অধ্যায়ন করেন। মার্কস একাধারে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদের প্রবক্তা ও আবিষ্কারক ছিলেন। বস্তুত হেগেল, ফয়েরবাখ, ডারউইন এর তত্ত্ব অধ্যায়ন-গবেষণা মার্ক্সকে বস্তুবাদী দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ হতে বিশেষ প্রেরণা জোগায়। ১৮৪৪ সালে মার্কসের পরিচয় হয় এঙ্গেলসের সাথে। মার্ক্স-এঙ্গেলস ১৮৪৭ সালে বসন্তকালে কমিউনিস্ট লীগে যোগ দেন। ওই বছরের নভেম্বরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট লীগের ২য় কংগ্রেসে তাদের দু’জনকে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন ফ্রান্স, জার্মান ও ইংল্যান্ডসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম হওয়াতে সমাজ ব্যবস্থায় নতুন এক প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর সংখ্যা, চেতনা, সাংগঠনিক ভিত্তি বেড়ে তা শ্রেণী সংগ্রামের চেতনায় রূপ নিতে থাকে। এতে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। তখনকার সময় এই প্রেক্ষাপটে রচিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে বুর্জোয়া শ্রেণী।
সত্যিই কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার সর্বহারা বিপ্লবের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য, বুর্জোয়া এবং সর্বহারা শ্রেণীর মধ্যে শ্রেণী সম্পর্ক, শ্রেণী সংগ্রাম এর দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণ, সর্বহারা ও কমিউনিস্টদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যা বিশ্বে সর্বাধিক পঠিত ও গুরুত্ববহনকারী সর্বোৎকৃষ্ট দলিল হিসাবে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। কেবল তাই নয়, কার্ল মার্ক্স আজ সারা বিশ্বের সর্বসেরা দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, মেহনতি মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক। দুনিয়া জুড়ে তার খ্যাতি। মার্কসবাদ হলো সমাজ বিকাশের তত্ত্ব, প্রকৃতি বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান নিয়ে দ্বান্দ্বিক ভিত্তিতে রচিত তত্ত্ব-দর্শন-মতবাদ। মার্ক্সবাদ প্রকৃতি ও ইতিহাসের গতি পরিবর্তন ও রূপান্তরের তত্ত্ব। মার্কসবাদ তাই একটি গতিশীল বিজ্ঞান। মার্ক্সবাদ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দর্শন, অর্থনীতি-রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি ও মুক্তির মতবাদ। প্রকৃতি ও সমাজবিজ্ঞানের সমন্বয় ও নিয়ম সমূহের তত্ত্ব। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বের আবিষ্কার মহামতি মার্ক্সের অন্যতম কীর্তি।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ-লুটেরা পুঁজিবাদীদের শোষণ-লুণ্ঠন ও নিপীড়নের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘ সময় ধরে সাম্রাজ্যবাদ, লুটেরা-পুঁজিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা নতুন নতুন কায়দায় পুঁজিবাদী কাঠামো-উৎপাদন-বণ্টন, শোষণ-লুণ্ঠনে ফন্দি-ফিকির করছে। শ্রেণী সংগ্রামকে ভোতা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ ও শ্রমিক শ্রেণীও বসে নাই। তাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের ভাষাও কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। ফলে শ্রেণীসংগ্রামের মাত্রাও তীব্রতর হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মার্ক্স-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহারে বলেছেন,“উৎপাদন যন্ত্রের অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে এবং তার দ্বারা উৎপাদন সম্পর্কসমূহের এবং সেগুলির সাথে সাথে সমাজের গোটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী টিকে থাকতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদ তার প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান বাড়াতে বিশ্বের দেশে দেশে শোষণ লুণ্ঠন, নিপীড়ন বজায় রাখতে মুৎসুদ্দি ও লুটেরা বুর্জোয়াদের সাথে জোটবদ্ধ এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। এই অশুভ জোটের বিপরীতে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক শ্রেণী তাদের দাবি ও অধিকার আদায়ের জন্য শ্রেণীসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। শোষণ মুক্ত সমাজ, সাম্যবাদ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণী তাদের শ্রেণী সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে।”
মার্ক্স-এঙ্গেলসের সময়ের পৃথিবী আর আজকের পৃথিবী এক জায়গায় নেই। বর্তমান বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে হয়। একসময় মনে হয়েছিল উন্নত পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতা দখল করবে, কিন্তু তা হয় নি। বরং অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশ, আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি প্রধাণ দেশেই শ্রমিক শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব হয়েছে। তাই শ্রেণীহীন শোষণ মুক্ত সমাজ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বে শ্রেণী সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। এটাই মার্ক্সবাদের শিক্ষা। কার্ল মার্ক্স কেবল আমাদের পথ প্রদর্শক নয়, তিনি এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুং সহ বিশ্বের শত শত নেতা ও কোটি কোটি মেহনতি মানুষের নেতা। মার্কসবাদ আজো প্রাসঙ্গিক। কারণ সমাজতন্ত্রের মৃত্যু নেই।
মহামতি কার্ল মার্ক্স সংগ্রামী লাল সালাম।