বাঙলার পলি মাটিতে বিভেদ ও বিভাজনের বিষ ছড়ানো হচ্ছে চারদিকে। নাগিনী’রা তুলছে উদ্ধত ফনা।করোনার মহামারিতে বিপন্ন বাংলার জনপদ,বিপর্যস্ত জনজীবন।এই দু:সময়ে মনে পড়ছে বাঙলার প্রাণপুরুষ আমাদের কবি,বিশ্বকবি-‘কবিগুরু’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।কবি গুরু লালনের মানবতার দর্শনে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে সাহিত্যচর্চায়,জীবনবোধে আত্মস্থ করেছেন,খুব গভীরভাবে।রবীন্দ্রনাথের হাতধরে আমাদের লাননের মানবিকবোধ,দর্শন,সাহিত্য বিকশিত হয়েছে, হয়েছে পুষ্পিত ।আমাদের ভাষার লড়াই, স্বাধীনতা -বাঙলার হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল মানবিক সংস্কৃতি’র ফসল।বাংলার গৌরবোজ্জ্বল সেক্যুলার, মানবিকসংস্কৃতির অন্যতম পুরোধা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।বৃদ্ধ লালন একটা সাদামাটা কাঠের চেয়ারে সাধারণ বেশভূষায় সামনের দিকে বসে আছেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক লেখায় বলেছেন, “লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন, আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।” দেড়শ বছর আগে লালন লিখেছেন, ‘ এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যবে হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ খৃষ্টান জাতিভেদ নাহি রবে।’
লালনের বহু গানে সেক্যুলার মানবিকতার চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে।লালনের মানবিক সৌন্দর্য ও রহস্যময়তা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও প্রভাবিত করেছিল।আমরা কী আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতিতে বাঙলার নিজস্ব স্বকীয়তা- সংস্কৃতি সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করতে পারছি!রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্পষ্ট করে বলেছেন,ভারতবর্ষে ও বাঙলায় বৈচিত্র্যের মধ্যে যারা ঐক্য সাধন করতে পারবেন তারাই হবেন সফল সাধক।আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম পথ চলেছেন জাতপাতের বিপরীতে।মানবতার আলোর পথেই। তার কবিতায় ভগবানের বুকে লাথি মেরে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। বলেছেন -” গাহি সাম্যের গান,মানুষের চেয়ে নহে কিছু বড়, নাহি কিছু মহিয়ান’।বাংলার নগরকেন্দ্রিক মুসলিম সমাজের একটি অভিজাত ক্ষুদ্র অংশ ধর্মকে জাতীয় পরিচয়ের প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতেন।তারা আর্যদের মতো বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরোধীতা করছে। তারা বলেছিল,বাঙালি মুসলমানদের ভাষা কোনভাবেই বাংলা নয়।মুসলমানদের ভাষা উর্দু- ফারসি।এ বিতর্ক বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত গড়িয়েছে। ওরাই তৈরি করেছিল “দ্বিজাতিতত্ত্ব”।’৭১ এ আমরা ওদের রাজনীতিগতভাবে পরাস্ত করেছি।সংস্কৃতিগতভাবে এখনো ওরা পরাস্ত হয়নি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের ভাষার গৌরব ও সৌরবকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন।বিশ্ব দরবারে তিনি বাঙলা ভাষার মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।বাঙলার সমাজ,সংস্কৃতিতে আছে পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী,আছেন হিন্দু- মুসলিম,বৌদ্ধ-খৃষ্টান।আছেন মতুয়া-দলিত সম্প্রদায়।বহুত্ববাদী সংস্কৃতি!শ্রেণি দ্বন্দের সাথে বাঙলার স্বকীয়তা ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে কী ভাবে মেলানো যাবে- সেই সমন্বয়ের কাজটিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে ধরতে হবে সকলকেই।মানবিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার বিকাশ মানুষকে সেক্যুলার মননের পথে নিয়ে যায়।এই বিকাশের পথ ধরেই মানুষের ব্যবহারিক জীবনে বিজ্ঞান অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।মানবিক ও ব্যবহারিক জীবনে, বিজ্ঞান- ভাষা- সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেলবন্ধনের পক্ষে ছিলেন ।কিন্তু বাঙালির নিজস্ব স্বত্বা ও স্বকীয়তায় রক্ষায় তিনি ছিলেন বাঙালির আত্মা।তিনি বিশ্বকে দেখতে চেয়েছেন মানবিক বিশ্ব হিসেবে।করোনার অতিমারির দু:সময়েও প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ।শতবর্ষ আগে কলেরা,প্লেগ,ম্যালেরিয়াসহ নানান রোগে বাঙলায় নেমে এসেছিল মৃত্যুর মিছিল।মানুষের চরম দুর্গতি।মানুষের জীবন হয়েছিল বিপন্ন।কবি মহামারি ঠেকাতে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নকল্পে নিয়েছিলেন নানামুখী পদক্ষেপ।সেদিনও ধর্মান্ধ-কুপমন্ডক শক্তি মহামারি ঠেকানোর গৃহীত বিজ্ঞানপন্হার বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার।রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়েছিলেন কুপমন্ডকতার বিরুদ্ধে।তিনি বুঝেছিলেন, মহামারি-পীড়িত গ্রামকে বাঁচাতে শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় কাজ হবে না।মহামারি ঠেকাতে,জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে সামাজিক প্রচেষ্টাকে জোরদার করার উপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।এবং তিনি নিজের উদ্যোগে এতদসংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালনা করেছেন।২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০ তম জন্মদিনে নিবেদন করছি শ্রদ্ধার্ঘ।
লেখকঃ অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী, পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।