মঙ্গলবার,১৯,মার্চ,২০২৪
33 C
Dhaka
মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়আফগানিস্তান: কার জয় কার পরাজয়

আফগানিস্তান: কার জয় কার পরাজয়

।। শরীফ শমশির ।।

শরীফ শমসির

মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আকন্দকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী করে আফগানিস্তানে সরকার গঠনের মাধ্যমে তালেবানরা বিশ বছরের যুদ্ধের রাজনীতিকে সংহত করল। এই সরকারের নানা পদে যারা নিযুক্ত হয়েছেন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশাকে হতাশ করেছে বলে আপাতত প্রতীয়মান হচ্ছে, কারণ নিয়োগপ্রাপ্ত ‘অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সন্ত্রাসী খাতায় তালিকাভুক্ত। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারকে পর্যবেক্ষণে রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তালেবানদের এই সরকার গঠনে তাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ যতটুকু না মিডিয়ায় আসছে তার চেয়ে বেশি আসছে পশ্চিমা ন্যাট জোট ও জি-৭ ভুক্ত দেশসমূহের সরকার প্রধানদের প্রতিক্রিয়া। ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়াও হতাশাজনক। তাদের মতে এই তালেবান সরকার অর্ন্তভূক্তিমূলক হয়নি। সরকারে দোহা আলোচনার পক্ষমসমূহ বিশেষ করে হামিদ কারজাই , আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার প্রমূখের অংশগ্রহণ স্পষ্ঠ হয় নি। এ ছাড়া পশ্চিমা ও জি-৭ এর দাবি মতে তালেবানরা দোহা সমঝতার আরো কয়েকটি শর্ত আপাতত মানছে না, যেমন নারীর অধিকার এবং আন্তর্জাতিক কোনো ইসলামিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করতে না দেওয়া। আগস্টে সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার সময় লোকাল আইএস শাখার বোমার আঘাতে তের মার্কিন সৈন্যসহ অনেকেই নিহত হন।

তালেবান সরকার ইতিমধ্যেই তাদের আদর্শের কথা স্পষ্ট করেছেন, আফগানিস্তানে শরীয়া আইন চালু হবে। নারীদের বিষয়ে তারা আগের মত’ই পোষণ করে। তের বছরের উর্ধ্বে কোনো নারী শিক্ষা নিতে গেলে বিশেষ ব্যবস্থায় তা নিতে হবে এবং চাকরি এবং প্রকাশ্য স্থানে তাদের নিরুৎসহিত করা হবে। কাবুলে এসব বিষয় নিয়ে কিছুটা হৈ চৈই হলেও আফগানিস্তানের অন্যান্য জায়গায় নীরবে কি হচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়া তা নিয়ে কিছু বলছে না। কারণ পশ্চিমা মিডিয়া কাবুলের রাজনৈতিক পালাবদলের নাটকটির ওপর তাদের ক্যামেরা তাক করে বসে আছে এবং কারা আলোয় আসছে আর কারা ছায়ায় অবসিত হচ্ছে তার যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ মেলানোর চেষ্টা করছে।

আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দখলদার যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী এবং তালেবানরা উইন উইন পরিস্থিতিতে আছে। ট্রাম্প সরকারের আমল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সৈন্যদের আফগানিস্তান ত্যাগের প্রস্তুতি শুরু হয় এবং তালেবানদের সঙ্গে সমঝোতার সিঁড়ি বেয়ে তারা আগস্ট মাসে আফগানিস্তান ত্যাগ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে আফগানিস্তান ত্যাগ করে রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনি, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সামরিক বাহিনীর সহযোগীবৃন্দ বিভিন্ন দাতা সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং মানবাধিকার কর্মীগণ। কাবুল বিমান বন্দরে দেশ ত্যাগের যে প্রাণান্তর প্রচেষ্টার দৃশ্য মিডিয়ায় দেখা গেছে তাতে কে প্রাণভয়ে যাচ্ছে আর কে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব অভিবাসী হতে যাচ্ছে তা বোঝা মুশকিল ছিল। কিন্তু এই দৃশ্যের রাজনীতি যদি বোঝার চেষ্টা করি তাতে দেখা যাবে বিশ বছরের মর্কিন-ন্যাটো দখলদারিত্ব ছিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বা আফগান জনগণের ‘মুক্তি’ নয় স্রেফ ‘ইসলামোফোবিয়া’ এবং বর্ণবাদ। টুইনটাওয়ারে আল কায়দার হামলার জবাবে বুশ-ব্লোয়ারের নির্লজ্জ মিথ্যাচার এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে যুদ্ধ বাবদ সামরিক হস্তক্ষেপে লক্ষাধিক লোক নিহত হন এবং হাজার হাজার লোক বাস্তুচ্যুৎ হন। পালিয়ে যান আরো লক্ষাধিক মানুষ। বিশ বছরের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আফগান জনগণ, লাভবান হয় পশ্চিমাদের মিলিটারি-ইন্ডাসট্রিয়াল-সার্ভিস কমপ্লেক্স আর তাদের আফগান সহযোগীরা। আফগানিস্তানের অর্থনীতি, গণতন্ত্র, জনগণের মুক্তি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি যুদ্ধের ডামাডোলে চাপা পড়ে আটকা পড়ে এবং তালেবানদের অর্থের উৎস হিসেবে পপি চাষ ফুলে ফেঁপে ওঠে। হিন্দুকুশ পর্বতে বিভিক্ত আফগানিস্তান পশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেস, চাহার আইম্যাক ও তুর্কমেনসহ নানা উপজাতিতে আলাদা আলাদা হয়ে নিরন্তর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যুদ্ধবাজ জাতিতে পরিণত হয়। আফগানিস্তানে এখন প্রত্যেকটি গোত্র/জাতি/উপজাতি ‘ওয়ারলর্ড’ এবং অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত। ‘মুজাহিদীন’ নামের আড়ালে সুন্নী মুসলিমদের যুদ্ধবাজরা সংগঠিত মার্কিন-সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র অর্থায়নে সংগঠিত পশতুনরা পুরনো যুদ্ধবাজদের সরিয়ে নতুন যুদ্ধবাজ হিসেবে অবিভূত হয়। এই তালেবানরা মার্কিন-পাকিস্তানের সৃষ্ট নায়ক-প্রতি নায়ক এবং আবার নায়ক বলে বিবেচিত হচ্ছে। তালেবানরা শরিয়া শাসনের আড়ালে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল বিপ্লবের মাধ্যমে যে গণতান্ত্রিক জাগরণ তৈরী হয়েছিল, নাজিবুল্লাহ সরকারের সংস্কারের মাধ্যমে যে জনগণের মুক্তির ধারা তৈরী হয়েছিল তার বিপরীতে মার্কিন-পকিস্তান-সৌদি সৃষ্ট রাজনৈতিক-ইসলামের চর্চা করে শোষণমূলক রাজনীতি ও দমনমূলক যুদ্ধবাজ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় রত। তালেবান সরকার বর্তমানে যে সকল নীতিমালা ঘোষণা করছে তাতে আফগান জনগণের মুক্তির কোনো ঘোষণা নেই, নেই আফগান গরীব কৃষক, পশুপালকদের মুক্তির কোনো কর্মসূচী, নেই নারী ও শিশুদের নাগরিক অধিকার। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে জাতিতে/উপজাতি-উপজাতিতে ঘৃণা ও যুদ্ধ জারি থাকায়। আফগান জনগণের উপর সুন্নী পশতুন সংখ্যাধিক্যের নিপীড়নমূলক শাসন অভ্যন্তরীণ শান্তি আনয়নের প্রধান বাধা। এই দ্বন্দ্বের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের হিসাবে রেখেছে, তাই তারা আফগান ভবিষ্যৎ বাণী করছে। আফগানিস্তান গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তালেবান সরকারের ক্ষমতা মতই সংহত হচ্ছে ততই জোরদার হচ্ছে অর্থনৈতিক দুর্দশা ও দুর্ভিক্ষের কথা। মানবিক বির্যয়ের আগাম হুশিয়ারি দিচ্ছে জতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহ। জার্মানসহ পশ্চিমা জোট ঘোষণা করেছে আফগানিস্তানে তালেবানদের সাথে পশ্চিমাদের সমঝোতা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে ‘হিউম্যানিটারিয়ান এইড’। পশ্চিমারা তালেবানদের পর্যবেক্ষণ করার নামে নানা সুতো টানা দিবে যাতে তালেবান পুতুল সরকার ও তাদের তাবেদারে থাকে।

আফগানিস্তানে তালেবানদের বিশ বছরের যুদ্ধে এগার দিনেই সামরিক সফলতা এনে দিয়েছে বলে বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে আমলে তা দোহা সমঝোতার ফল। পশ্চিমারা আফগানিস্তানকে ভাগ-ভাটোয়ারা করেছে। বিক্রি করে দিয়েছে জনগণের মৌল স্বার্থ। সামগ্রিক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে বর্তমান তালেবান সরকার বিশ বছর আগের তালেবান সরকারের চেয়ে নৈতিকভাবে অনেক দুর্বল। বর্তমানে তাদের বিজয় সামরিক নয়, কূটনৈতিক। তালেবানদের একদল প্রশিক্ষিত নেগোশিয়েটর দক্ষতার সাথে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো, জি-৭, পাকিস্তান, চীন, ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করতে সমর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে তারা আফগানিস্তানে এসেছিল এখন তারা চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। সমঝোতার কারণে তারা ‘ডেডলাইন’ ঘোষণা করে প্রস্তুতি নিয়ে আফগানিস্তান ছেড়েছে। পাকিস্তান-সৌদির সুন্নী ভিত্তিক রাজনৈতিক ইসলামের জয় নিশ্চিত হয়েছে এবং তালেবানরা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড; এবং নিশ্চয়তা দিয়েছে এবং মধ্য এশিয়ায় রাশিয়াকে আশ্বস্থ করেছে এবং ইরানও আশ্বস্থ হয়েছে। আফগানিস্তানের সদ্য আবিষ্কৃত মিনারেল উত্তোলন ও বাজারজাত করার বিষয়টিও সমঝোতার মধ্যে ছিল। চীন ইতিমধ্যেই তালেবানদের আর্থিক সহায়তার আশ^াস দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই অংশগ্রহণকে আপাতত মেনে নিয়েছে। সামান্য বিপাকে পড়েছিল ভারত, তবে তাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত-তালেবান সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। এই সকল পক্ষের সমঝোতার শর্ত যতক্ষণ শান্তিপূর্ণ থাকবে ততক্ষণ তালেবানরা সরকার চালতে পারবে, যখনই পারস্পরিক স্বার্থসমূহ বিরোধপূর্ণ হবে তখনই তাদের ক্ষমতার আসল ফাঁকিটি বের হয়ে আসবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের এই পট পরিবর্তনে নানা মুখী প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ভারত ভয়ে আছে কাশ্মীর প্রশ্নে, চীন-পাকিস্তানের অক্ষরেখা তৈরীকে পাকিস্তান ভয় পাচ্ছে আফগানদের স্বাধীনতারপ্রিয়তাকে, শ্রীলঙ্কা-নেপাল আপাতত অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবিত। বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া বহুমুখী। পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন তালেবান সরকারকে তারা পর্যবেক্ষণে রাখবেন, রাজনৈতিক ইসলামের সমর্থকরা আনন্দিত হয়েছেন এবং আশায় বুক বাঁধছেন আর প্রগতিশীলরা তালেবানি জুজুর ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু সামগ্রিক পর্যালোচনায় ধারণা করা যায় তালেবানরা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতিতে আশা জাগালেও আফগানিস্তানের ভূমি এবার আর্ন্তজাতিক ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো আগের মত ব্যবহার করতে পারবে না।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও জনগণের মুক্তির বিষয়টি বিশ্ব সভায় তুলে ধরা এবং অন্যদিকে আফগানিস্তানের গরিব জনগণের মুক্তির প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে তুলে ধরার দায়িত্ব হলো এদেশের বাম-প্রগতিশীল শক্তির। তালেবানি জুজুর ভয় নয় বরং আফগানে সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমে, উপজাতি যুদ্ধ বন্ধে, কৃষক-শ্রমিক ও নারীর অধিকার আদায়ে এবং তালেবানি-পশ্চিমাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। যাতে বাংলাদেশে ও যুক্তরাষ্ট্র-ন্যাটো জোট ও জি-৭ এর দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের শক্তি জোরদার হয়।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

সর্বশেষ