Site icon নতুন কথা

আমার দৃষ্টিতে নেপাল

NotunKotha

হিমালয় কন্যা নেপাল

।। ড. ইঞ্জিনিয়ার এস, কে, আহমেদ কামাল ।।

এস, কে, আহমেদ কামাল

প্রতিটি দেশ ও জনগনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলিকে উন্নত-অনুন্নত বা ধনী-দরিদ্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সেহিসাবে নেপালকে কোন পর্যায়ের দেশ হিসাবে বিবেচনা করা যায়, তা নিয়ে আমার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। অনুন্নত আর দরিদ্র হিসাবে চিহ্নিত দেশগুলিতে আইন-শৃঙ্খলা ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব আর পরমুখাপেক্ষিতা পরিলক্ষিত হয়। সেসব দেশের সরকারগুলির বা সরকারী কর্মচারীদের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক রাজা ও প্রজার সম্পর্কের মতো। প্রজাদের রাজার অনুগ্রহে বেঁচে থাকতে হয়। নেপালে আমার দৃষ্টিতে সেই সম্পর্ক নাই। রাজধানী কাঠমান্ডুতে যে নাগরিক সুবিধা বিদ্যমান তাতে জনগনের প্রতি সরকারের দায়িত্বশীলতাই পরিলক্ষিত হয়। সরকারী অফিসে যত দ্রুত সম্ভব সেবা প্রদানের প্রমান আমি পেয়েছি। বাংলাদেশসহ ভারত ও পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারীদের যে হামবড়াই ভাব দেখেছি, এখানে তা দেখিনি। জনগণ অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের, জোরে কথা বলতে কাউকে শুনলাম না। খাবারের দোকানগুলি অত্যন্ত পরিস্কার, রান্নাঘর লুকানো নয়, স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের ভেতরে সব দেখা যায়। আরো মজার ব্যাপার প্রায় সব খাবার দোকানেই মদ্য পরিবেশন করা হলেও কখনো কাউকে মাতলামি করতে দেখলাম না। রাস্তায় বলতে গেলে হর্নের শব্দ শোনাই যায় না। বেশীর ভাগ গাড়ী ছোট সাইজের – ভারতীয়  মারুতী সুজুকী৷ তবে মুল যানবাহন মোটর বাইক বা ছোট সাইজের স্কুটী। ছেলে মেয়ে সবাই চালায়। ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের কোন নজির এখনো নজরে আসেনি। হঠাৎ ঠোকাঠুকি লেগে গেলে অত্যন্ত শান্তভাবে মিটিয়ে ফেলে। এর ফলে রাস্তায় জানজট খুব কম, কোথাও পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বেশী আটকে থাকতে হয় না। রাজনৈতিক কোন্দল আছে, তবে তা মারমুখী নয়, হরতাল একদিন হয়েছিল, তবে দোকানপাট বন্ধে জোরাজুরী নাই। চার চাকার গাড়ী বাদে রাস্তায় সবই চলেছিল। দোকানপাট অধিকাংশ বন্ধ থাকলেও তা স্বতঃপ্রণোদিত। নির্বিঘ্নে মেয়েরা ছেলেদের মতোই চলছে এবং দোকানপাট মেয়েরাই চালাচ্ছে। মেয়েদের নিরাপত্তা আর সম অধিকার সুস্পষ্ট। প্রতিটি খাবারের প্যাকেটে মেয়াদ লেখা নেপালী তারিখে এখন তাদের ২০৭৭ সাল। দোকানে বলতে গেলে একদাম। দরাদরি করলে বিরক্তই হয়।

করোনাকালে আমাকে প্রয়োজনে নেপালে আসতে হয়েছে এবং করোনা শুরুর পর থেকে আমাকে বাংলাদেশ ও কানাডায় থাকতে হয়েছে। এই সময়ে আমার কাছে নেপালের করোনা মোকাবেলার সচেতনতা সব চেয়ে কার্য্যকর মনে হয়েছে। জনগন রাস্তায় কখনো মাস্ক ছাড়া চলেনা। এমনকি আমার বাসার গৃহকর্মী আমি কিছু না বলা সত্বেও কর্মকালীন সার্বক্ষণিক মাস্ক পরে থাকে। নেপালে আরো একটি ব্যবস্থা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে যে যেখানেই যাওয়া হোক না কেন, আপ্যায়নে সর্বপ্রথমে এক গ্লাস গরম পানি দেয়া হয়। যে কোন দোকানে বা রেস্তোরায় ঢুকলে প্রথমেই স্যানিটাইজারে হাত মুছতে হবে। লোকজনের দৈনন্দিন কার্যক্রম একবারে স্বাভাবিক, কোন প্যানিক নাই। কোন বিশেষ প্রচারনা নাই শুধু মোবাইল ফোনে সতর্ক বানী ছাড়া। তাই সংক্রমন অত্যন্ত কম। নেপালের অর্থনীতি টুরিজম নির্ভর। করোনাকালে ট্যুরিস্ট না আসার ফলে সকলের আর্থিক কষ্ট চলছে, কাঠমান্ডুর রেস্তোরা আর অভিজাত দোকানগুলি ক্রেতার অভাবে বেশ নির্জীব, তবে কারো মুখে কোন অভিযোগ বা দোষারোপ শুনলামনা। সকলেই এটাকে অনিবার্য পরিস্থিতি হিসাবে গ্রহন করেছে।

নেপালে প্রায় সবকিছুই. আমার মতে একটি উন্নত দেশে যা আশা করা যায়. আছে শুধু টয়লেট ব্যবস্থাপনা ছাড়া৷ কানাডায় গন শৌচাগার ছাড়াও ম্যাকডোনাল্ডস ও টিম হরনটনের মতো ফাষ্টফুডের দোকানগুলির টয়লেট সকলের জন্য উন্মুক্ত কোন কেনাকাটা না করলেও। নেপালে ম্যাকডোনাল্ডস দেখিনি, তবে খাবার দোকানেই টয়লেট আছ, কিন্ত তা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। উন্নত দেশগুলির বৈশিষ্ট্য হিসাবে আমি টয়লেট ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক দায়িত্ববোধে নাগরিক সচেতনাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেই। নেপালে রাস্তায় ডাষ্টবিন সেরকম নজরে না আসলেও তেমন কোন আবর্জনা রাস্তায় নাই শুধু নাগরিক সচেতনতার কারনে। কানাডায় যত্রতত্র আবর্জনা ফেললে জরিমানার আইন আছে, নেপালে তেমন আছে কিনা জানিনা. তবে পারিবারিক শিক্ষা আছে, সেটা স্বীকার করতেই হবে। তাই অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে নেপালকে উন্নত না বললেও নাগরিক সচেতনতায় আমি নেপালকে উন্নত দেশ বলতে চাই।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

(নিবন্ধে প্রকাশিত অভিমত লেখকের একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিগত। এটি সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে- সম্পাদক)

Exit mobile version