আলুর নৈরাজ্যে মজা মারছে মধ্যস্বত্তভোগি-ব্যবসায়ীরা ঠকছে চাষী আর ক্রেতা

দু’দফা দাম বেঁধে দিয়েও নৈরাজ্য দমাতে পারছে না সরকার * ফল মিলছে না টিসিবি’র মাধ্যমে আলু বিক্রিতে * কৃত্রিম সঙ্কটে মুনাফা লুটেই যাচ্ছে * কোল্ড স্টোরেজের বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করলেই আলুতে সয়লাব হবে বাজার
নতুন কথা প্রতিবেদন \ পেঁয়াজ ও চালের পর আলুতে নৈরাজ্য চলছে দেশজুড়ে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামের তোয়াক্কাই করছেন না ব্যবসায়িরা। ইচ্ছে মতো তারাই দাম নির্ধারণ করে আলু বিক্রি করছে। এতে দারুনভাবে ব্যহত হচ্ছে ক্রেতা স্বার্থ। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই অসহায়ের ভূমিকা পালন করছে সরকার। ব্যবসায়িদের সঙ্গে না পেরে শেষে আরেক দফা দাম বেঁধে (কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছে) দিতে হয়েছে।। এরপরও ব্যবসায়িদের মন ভরে নি। তারা চড়া দামেই আলু বিক্রি করছে।
আলুর বাজার স্থিতিশীল রাখতে ৭ সেপ্টেম্বরখুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ৩০ টাকা বেঁধে দেয় সরকার। তা কার্যকর করতে না পেরে গত ২০ অক্টোবর দ্বিতীয় দফা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ৫টাকা বাড়িয়ে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রতিকেজি আলু খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করছে ৫০ টাকায়। আর পাইকারি সরকার নির্ধারিত ৩০ টাকা কেজি আলু বিক্রির কথা থাকলেও আড়তে তা বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকায়।
বাজার সংশ্লিষ্টদের অনেকে জানিয়েছেন, বেশি দরে বিক্রি করতে রাজধানীর পাইকারি আড়তগুলো থেকে আলু সরিয়ে বিক্রি বন্ধ রেখেছে পাইকাররা। এছাড়া খুচরা বাজারে অন্যান্য সবজির সঙ্গে আলু প্রদর্শন না করে লুকিয়ে বেশি দরেই বিক্রি করা হচ্ছে। দেশে পর্যাপ্ত আলু থাকার পরও ব্যবসায়ীরা এভাবে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে জনগণের পকেট কাটছে।
২০ অক্টোবর সাংবাদিকরা রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলুর আড়তে গিয়ে দেখতে পান সরকার নির্ধারিত দাম (প্রতি কেজি ৩০ টাকা) অমান্য করে ৪২-৪৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। একপর্যায়ে আলু বিক্রি বন্ধ করে বস্তা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন ব্যবসায়ীরা। এ বাজারে আলু কিনতে আসা এক ক্রেতা অভিযোগ করেন, পাইকারি আড়তে কোনো আলু নেই। এটা কি ধরনের কথা? পাইকাররা সব এক হয়ে আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু সরকারের বাজার তদারকি সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে পাইকারদের সেই পুরানো বুলি-আড়তে যে আলু আছে তা বেশি দাম দিয়ে দু-তিন দিন আগের আনা। তাই বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। কম দামে বিক্রি করতে পারব না, এজন্য আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি।
এদিকে কাঁচাবাজারের দোকানগুলোতে এখন আলু প্রদর্শন করে রাখা হয় না। বিক্রেতার কাছে আলু আছে কিনা জানতে চাইলে বলা হয়,সাজানো নেই। ঝুড়ির ভেতরে আছে। কত কেজি লাগবে বলেন? দাম জানতে চাইলে বলেন ৪৮ বা ৫০ টাকা কেজি। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল, খুনলা-সব জায়গায় একই অবস্থা। কোথাও সরকারের বেঁধে দেয়া দামে আলু বিক্রি করা হচ্ছে না। আলুর জেলা মুন্সীগঞ্জে দাম চাড়া। মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম ৫০ শতাংশের ওপর এবং বছরের ব্যবধানে প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে গত মৌসুমে প্রায় ১ দশমিক ৯ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। বছরে মোট আলুর চাহিদা প্রায় ৭৭ দশমিক ৯ লাখ টন। অর্থাৎ প্রায় ৩১ দশমিক ৯১ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত আছে। সামান্য পরিমাণ রফতানি হলেও ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই। তারপরও দাম বাড়ানো হয়েছে।
ব্যবসায়িদের এই আচরণ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্য হলো, বাস্তবতা বিবেচনা করে আমরা আরও পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করে দিলাম। কিন্তু আলুর দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এটা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যবসায়ী, আড়তদারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা মুনাফা করেন, মুনাফা করার জন্যই ব্যবসা করছেন। কিন্তু এ সুযোগে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার চিন্তা করবেন না। মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, আপনারা সরকারের নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করুন।’
কিন্তু মুনাফাখোররা কি মন্ত্রীর এই আহŸানে সাড়া দেবে? দেবে না। কারণ মুনাফাই ওদের কাছে প্রধান। মানুষ, দেশ, জাতি ওদের কাছে কিছুই না। তাই যদি হতো ভারতের রফতানি বন্ধের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে পোঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে না। কারণ ওই পেঁয়াজতো আগে আনা। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িরা কিন্তু অগে কেনার যুক্তি মানছে না।
উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ২১ অক্টোবর থেকে রাজধানীর ৮০টি পয়েন্টে ২৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি আলু কিনতে পারছেন। টিসিবির এসব বিক্রয় কেন্দ্রে সব শ্রেণির ক্রেতার উপচে পড়া ভিড়। মহিলা ও পুরুষ পৃথক লাইনে দাঁড়িয়ে আলুসহ পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি কিনছেন। এর থেকেই বোঝা যায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা দারুনভাবে হ্রাস পেয়েছে। তা নাহলে টিসিবির পণ্য কেনার জন্য মানুষ এভাবে ভিড় করতো না। কিন্তু এভাবে কি বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? সারা দেশে বিক্রয় কেন্দ্র না খুলে শুধু রাজধানীতে বিক্রি করে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আলুর মজুদদার ও ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোল্ড স্টোরেজগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন। দেখবেন বাজারে আলুতে সয়লাব হয়ে গেছে।বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ চাষির কোল্ডস্টোরজে আলু রাখার সামর্থ নেই। জমি থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা আলু বিক্রি করে দেন। দাম পান কেজিতে বড় জোর ১৮-২০ টাকা। কিন্তু এই আলুই মজুদদাররা কিনে কোল্ড স্টোরেজে রেখে সুবিধামতো সময় বেশি দামে বিক্রি করেন। অর্থাৎ যারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তারা দাম বৃদ্ধির কোনো সুফল পান না। তাহলে মজা মারছেন কারা? সেই মধ্যসত্ত¡ভোগী মজুদদার-ব্যবসায়িরা। সরকার এই মধ্যসত্ত¡ভোগীদের কাছে বার বার আত্মসমর্পণ করে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রির আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু তাতে ফল মিলছে না।