শুক্রবার,১৯,এপ্রিল,২০২৪
32 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
Homeশিক্ষা সংস্কৃতিসংস্কৃতিএবারের একুশ হোক ভাষা বিকৃতির আত্মবিনাশী পথের রুদ্ধতালা

এবারের একুশ হোক ভাষা বিকৃতির আত্মবিনাশী পথের রুদ্ধতালা

এম এইচ নাহিদ: জীবন দিয়ে মাতৃভাষা রক্ষার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। বাঙালি’ই একমাত্র গর্বিত জাতি, যে জাতি লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কেবল তাই নয়-সালাম, বরকত, শফিক, রফিক, জব্বারের রক্তাস্নাত মহান ‘একুশ’ পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এখন বাঙালির সাথে পুরো দুনিয়ার মানুষ শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালন করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ’৫২-র ইতিহাস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও আজো পরিপূর্ণ রুপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বাংলা ভাষার মর্যাদা। ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছর পরেও সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু হয়নি। প্রশাসনসহ সবখানেই এখনো চলছে ইংরেজি ভাষার দাপট। সাইনবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপনেও ইংরেজির ছড়াছড়ি। নাটক-সিনেমাসহ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলোতে ‘বাংলা’ কে উপস্থাপন করা হচ্ছে বিকৃতভাবে। আর এম এফ রেডিওগুলোতে তো রীতিমতো ‘বাংলা ভাষা’ বিকৃত ও ব্যাঙ্গাত্মক উপস্থাপনের মচ্ছব চলছে। মানা হচ্ছে না উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও। নির্দেশনা বাস্তবায়ন হবেই বা কি করে! বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে যে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছে সর্বত্র ‘বাংলা’র প্রচলন করতে হবে, সেই উচ্চ আদালতে’ই স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পুরোপুরি বাংলায় রায় লেখার প্রচলন চালু করা যায় নি। যদিও কয়েক জন বিচারপতি বাংলায় রায় লিখে প্রমাণ করেছে চাইলেই উচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব। এভাবে ক্রমেই রক্ত দিয়ে রক্ষা করা বাংলা ভাষার অবমাননা চলছে অবাধে। অথচ ফি বছর ভাষার মাস এলেই সকলের মধ্যে জেগে ওঠে ভাষাপ্রেম, ‘বাংলা’র প্রতি প্রতি সীমাহীন দরদ! কিন্তু মাস শেষে’ই আবার একই অবস্থা। বছরজুড়ে চলে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি’র মিশেল ও বিকৃত উচ্চারণ। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত গৃহিণীরা আড্ডায় গর্ব করে বলেন, “জানেন ভাবী, আমার ছেলেটা না বাংলা বলতেই পারে না!”
‘ভাষা দূষণ নদী দূষণের মতোই বিধ্বংসী’-২০১৬ সালে প্রথম আলো’র উপসম্পাদকীয়তে এমন শিরোনামে লিখেছিলেন শিক্ষাবিদ ও কথা সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছয় বছর আগের সেই যুগান্তকারী শিরোনাম এই সময়ে এসেও সমভাবে প্রযোজ্য, বরং আরো বেশি। সত্যি নদী দূষণের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে ভাষা দূষণ। নির্বিচারে বাংলা ভাষাকে অবমাননা করা হচ্ছে। কোনোই প্রতিকার হচ্ছে না। বরং ভাষার বিকৃত ও মিশেল উচ্চারণ মানুষের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় সকল জাতি’ই তার মাতৃভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়েই এগিয়ে যেতে দৃঢ় প্রত্যয়ী ফরাসীরা। জার্মানি, ইটালি, জাপান, ব্রিটেন, আমেরিকায় সর্বস্তরের শিক্ষা প্রদান করা হয় মাতৃভাষায়। ১৩৯ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনের শিক্ষা ব্যবস্থাও মাতৃভাষায় চলে। আর আমরা বাংলাদেশ মাতৃভাষায় শিক্ষায় পরিবর্তে বিদেশী ভাষায় ঝোঁক বেশি। সম্প্রতি এক সেমিনারেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, জেলা পর্যায়েও প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলা মাধ্যমের সাথে ‘ইংলিশ ভার্সন’ও চালু হবে। যেখানে দুনিয়ার দেশগুলো শিক্ষা ও গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে মাতৃভাষায়। সেখানে আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজির প্রচলন বাদ না দিয়ে উল্টো প্রাথমিকেই শিশুর মনোজগতে বিদেশি ভাষা গেঁথে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে।
সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে, ‘বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষা হবে বাংলা’। ১৯৮৭ সালে সংবিধানের আলোকে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ করে সকল রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। তাতে বলা হয়, সকল সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল নথি ও চিঠিপত্র এবং আইন আদালতের সওয়াল জবাব ও অন্যান্য আইন বিষয়ক কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। তাতেও কাজ না হয়ওয়ায় ২০১২ সালে এবং ২০১৪ সালে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ বন্ধ এবং সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন করার নির্দেশনা জারি করেন উচ্চ আদালত। এই নির্দেশনা বলে দেশের সকল সাইনবোর্ড, গাড়ির নাম্বার প্লেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও হোটেল রেস্টুরেন্টের নাম বাংলায় লিখতে বলা হয়। একই সাথে টেলিভিশন, রেডিও সহ সকল গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ বন্ধের নির্দেশনাও দেওয়া হয়। কিন্তু কোথাও তা মানা হচ্ছে না। অন্যদিকে ‘কাজীর গরু কিতাবে থাকলেও গোয়ালে নেই’-এমন ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ আইন না মানার জন্য কোনো শাস্তি প্রদান চোখে পড়ছে না।
অন্যদিকে সংবিধান ও আইনের রক্ষাকবচ বিচারবিভাগের উচ্চ আদালতে দু’চার জন বিচারপতি বাংলায় রায় লিখলেও আজো পুরোপুরি রায় প্রকাশে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলিত হয়নি। অথচ আফ্রিকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া, জার্মান, চীন, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ড, জাপান এমনকী আমাদের পাশ^বর্তী দেশ নেপালেও উচ্চ আদালতে নিজেদের ভাষায় বিচার করা হয়।
বাংলাদেশকে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে যেতে হবে। এটা করতে আমাদের আত্মপরিচয়ের জন্য। কারণ ভাষার মধ্যেই জড়িয়ে আছে আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবোধের পরিচয়। যে পরিচয়ে ৯ মাসের লড়াইয়ে এ জাতি ছিনিয়ে এনেছে নিজেদের স্বাধীনতা। এ বছর তার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। ফি বছরের চেয়ে তাই এবারের ‘একুশ’ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ভিত্তি রচিত হয়েছিল ওই বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাই বাঙালির হৃদয়ে স্বাধিকারের লড়াইয়ের প্রেরণা জাগায়। একই সাথে এ বছর’ই স্বাধীন বাংলার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। ফলে এবারের ‘একুশ’-এর প্রত্যাশা তাই একটু বেশি। বঙ্গবন্ধুও প্রচ- ভাষাপ্রেমী ছিলেন। তিনি’ই প্রথম ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় বক্তব্য দিয়ে বিশ^বাসীকে তাক লাগিয়েছিলেন। তার আগে ১৯৭২ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনেও বাংলায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। চীনের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেছিলেন বাংলায়। কেবল তাই নয়, তিনি বজ্রকণ্ঠে বলতেন, “আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা। বাংলা আমার কৃষ্টি, সভ্যতা ও ইতিহাস।”
তাই মুজিববর্ষ ও সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উৎযাপনের প্রাক্কালে ৬৯তম ‘একুশ’ স্মরণে আমাদের শপথ নিতে হবে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার। অবাধ আকাশ সংস্কৃতির কারণে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে নবপ্রজন্ম যে মাতৃভাষার প্রেম হারিয়ে ফেলছে, বিকৃতভাবে বাংলা উচ্চারণ করছে তা থেকে ফেরাতে হবে। ভাষার বিকৃত উচ্চারণ বন্ধ করে লেখায়, বলায়, পঠনে-পাঠনে সর্বত্র বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মর্যাদার আসনে। সময়ের প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে, তবে দা নিজস্ব সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে নয়। এই আত্মবিনাশী পথ থেকে ফিরে আসতে হবে। এবারের ‘একুশ’ হোক সেই আত্মবিনাশী পথ থেকে ফেরার দৃঢ় শপথ-সেটাই সকলের প্রত্যাশা।

সর্বশেষ