শুক্রবার,১৯,এপ্রিল,২০২৪
32 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়এ বাজেট ‘জীবন ও জীবিকা’ কে রক্ষা করবে না

এ বাজেট ‘জীবন ও জীবিকা’ কে রক্ষা করবে না

।। ড. সুশান্ত দাস ।।

ড. সুশান্ত দাস

বাজেটের  শুরুতেই  জীবন ও জীবিকার ভারসাম্যের কথা বলা হয়েছে এবং হচ্ছে । কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত চিত্র কি সেটাই বিবেচ্য বিষয়।

এক নজরে বাজেট দেখলে বাজেটের মোটা চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোট বাজেট ৬,০৩৬৮১ কোটি টাকা, রেভিনিউ ৩,৮৯, ০০০ কোটি টাকা,  ঘাটতি ২,১৪, ৬৮১ কোটি টাকা। নিঃসন্দেহে বিপুল বাজেট। আর এটাও স্পষ্ট যে, বিপুল ঘাটতি বাজেট বিদেশনির্ভর হয়ে উঠছে।

শতাংশের হিসেবে উৎস ট্যাক্স রেভিনিউ ৫৪.৭%, ট্যাক্স রেভিনিউ ২.৬%, নন ট্যাক্স রেভিনিউ ৭.১%, আভ্যন্তরীণ ঋণ ১৮.৮%, বৈদেশিক ঋণ ১৬.২%, বৈদেশিক অনুদান ০.৬%। শতাংশের হিসাবে বরাদ্দ হলো পাবলিক প্রশাসন ১৮.৭%, প্রতিরক্ষা ৬.২% ,  কৃষি ৫.২%, স্বাস্থ্য ৫.৪%। শিক্ষা ও প্রযুক্তি ১৫.৭%। শিল্প ও অর্থনীতি ০.৭%। প্রশাসনিক ব্যয় ৩, ৬১, ৫০০ কোটি,  উন্নয়ন বাজেট ২, ৩৭, ০৭৮ কোটি । দেখা যাচ্ছে, সামরিক – বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও অনুতপাদনশীল খাতে ব্যয়ভার বাড়ছে, উতপাদনশীল খাতে বরাদ্দ ও উদ্যোগ কমছে।

পরিসংখ্যান আসল  চিত্রটিই  দেখায়। বোকা পরিসংখ্যানকে ফাঁকি দেওয়া যায় না । আরোও একটু খুঁটিয়ে দেখার জন্যে এই  বিশেষ বাস্তবতায় এই মুহূর্তে যে বিষয়গুলি বাজেটে প্রাধান্যে আসা উচিত সেগুলোই বিবেচনায় নেওয়া যাক।   

প্রথমেই স্বাস্থ্যখাত। স্বাস্থ্যখাতে  বরাদ্দ ৩২, ৭৩১ কোটি।  টিকা প্রদানসহ থোক বরাদ্দ রয়েছে ১০,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু তা কি ভাবে ব্যয় হবে তার নির্দিষ্ট নির্দেশনা নাই।

ভ্যাক্সিন ভিন্ন জীবন ও জীবিকা দুটোই অসম্ভব –এটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত। করোনাকে প্রতিরোধ  করতে হলে অন্ততঃ ১২ কোটি মানুষকে ভ্যাক্সিনের আওতায় আনতে হবে এটাও বৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চ অর্থাৎ  প্রায় ২৪ কোটি ভ্যাক্সিন প্রয়োজন । তাই দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, এক ভ্যক্সিনের উৎস কি? দুই, জনগণের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কি?  বাজেটে তার কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনুপস্থিত। মন্ত্রীরা বলছেন, মাসে ২৫ লক্ষ ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। তাতে লক্ষ্যে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে?

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো চিকিৎসা কাঠামো বৃদ্ধি ও উন্নয়ন। আমাদের দেশের চিকিৎসা কাঠামো যে কতটা অপ্রতুল এবং ভংগুর তা করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউতে বোঝা গেছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি। ফলে প্রয়োজন উপজেলা ভিত্তিক পরিকল্পনা। আই সি ইউ এবং ক্যানোলা প্রযুক্তিসহ অক্সিজেন সরবরাহ উপজেলা ভিত্তিতে নিশ্চিতকরণ জরুরি। বাজেটে এ সম্পর্কিত কোন পর্যালোচনা , পরিকল্পনা বা নির্দেশনা নাই ।

স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির বিষয়টি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাঁর প্রতিবিধানের বিষয়টিও আশু প্রয়োজন। সে সম্পর্কে কোন পর্যালোচনা বা প্রস্তাবনা নেই। বাজেট বরাদ্দ হলেই যে তা বাস্তবায়িত হয় না তা তো দিবালোকের মত স্পষ্ট।

শিল্পোদ্যগ ও কর্মসংস্থানের বরাদ্দ আপেক্ষিকভাবে নয় শুধু, কার্যতঃই অপ্রতুল। শিল্পক্ষেত্রে বরাদ্দ মাত্র ৪,০২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বস্ত্র ও পাটশিল্পে মাত্র ৬৯২ কোটি।

দুই কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে নেমে গেছে। ইতিমধ্যে মধ্যবিত্তের কষ্টার্জিত সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে   গেছে। নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ নিঃস্বতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বৈশ্বিকভাবে এই সতর্কবানী উচ্চারণ করেছে। তাদের  ক্রয়ক্ষমতা শূণ্যের কোঠায়। এটা আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে তা দূর্ভিক্ষে রূপান্তরিত হতে পারে। 

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারের একার পক্ষে কর্মসংস্থান করা সম্ভব নয়। বেসরকারী খাতকেই ভিত্তি হিসেবে নিতে হবে। সেজন্য রাষ্ট্রীয় খাতে কোন দৃশ্যমান বিনিয়োগ, উদ্যোগ বা পরিকল্পনা নেই। শিল্পখাতে ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল ইত্যাদি ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের করমুক্তি থেকে ঋণ প্রনোদনার কথা  বলা  হয়েছে কিন্তু সেখানে শ্রমঘন ও বেশী সংখ্যক কর্মসংস্থান কতটুকু হবে? বিপরীতে রাষ্ট্রীয় খাতে সদ্য বন্ধ করে দেওয়া জুট মিল, চিনি শিল্প প্রভৃতি ভিত্তিমূলক রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক শিল্প উদ্যোগের পরিকল্পনা দূরে থাক উল্লেখও নাই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সে বিবেচনার কথা বলেছিলেন,পাট শিল্পের ব্যাপারে  তারও  কোন প্রতিফলন বাজেটে নাই। বরং সংবিধান নির্দেশিত মালিকানার ধারণার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে বাজেট পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে।  

কৃষিখাত ও গ্রামীন অর্থনীতি এই মুহূর্তে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। এবার কৃষিখাতে বরাদ্দ ৩১, ৯৬২ কোটি । করোনা প্রাথমিকভাবে শহরভিত্তিক থাকলেও এখন দ্বিতীয় ঢেউ গ্রামের দিকে বিস্তৃত হচ্ছে, যা মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। দেশের প্রায় ৭৮% মানুষ কৃষি ও গ্রামীন অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। ইতিমধ্যে শহরে করোনা আক্রান্তের ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে গ্রামীন অর্থনীতির ও গ্রামীন কর্মসংস্থানের উপর প্রচন্ড চাপ পড়বে। তাকে মোকাবিলা করার কোন বিশেষ পরিকল্পনা বাজেটে অনুপস্থিত। করোনা আক্রমণ থেকে রক্ষা করে কৃষি ও গ্রামীন অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান করতে হলে প্রথমেই গ্রামীনজন গোষ্ঠির ৭০% কে ভ্যাক্সিনের আওতায় আনার পরিকল্পনা  এবং বরাদ্দ রাখতে হবে। গ্রামীন স্বাস্থ্যখাতকে স্বাধীনভাবে স্বনির্ভর করার লক্ষ্য এখনই নিতে হবে। বাজেট গতানুগতিক কৃষিঋণ আর বরাদ্দের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। কৃষিমন্ত্রী কৃষিখাতে বাজেট বরাদ্দে সন্তুষ্ট। কৃষিতে যন্ত্রায়ন হচ্ছে। কিন্তু এই যন্ত্রায়ন প্রকৃত কৃষককে কতটুকু সহায়তা করবে? তা ছাড়া কৃষিতে যন্ত্রায়নের ফলে যে কৃষি শ্রমিকরা কর্মহীন হবে তাঁদের কর্মসংস্থানের কি হবে? বিশেষ করে বিশ্ব   অতিমারির এই ভয়াবহ পরিস্থিতেতে- তার নির্দেশনা বাজেটে অনুপস্থিত।   

এই অতিমারিতে সম্ভবতঃ শিক্ষাখাতই সর্বাধিক এবং দীর্ঘমেয়াদীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ এর সঙ্গে জড়িত দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের গড়ে ওঠা। গোটা বিশ্বেই এটা আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। আমাদের দেশ বলতে ধ্বংসের দোরগোড়ায়। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বরাদ্দ গতানুগতিক। ৯৪, ৮৭৭ কোটি।  বাজেটের ১৫.৭%। জিডিপির ২.১% এর নীচে। গত এক বছর সকল বিদ্যায়তন বন্ধ। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থা এবং ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন রক্ষার কোন দিকনির্দেশনা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এ বাজেটে  অনুপস্থিত। বিশ্বব্যাপী বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটাকে মাথায় রেখে যে   পরিকল্পনা ও অর্থনীতিক বরাদ্দ প্রয়োজন তার সবটাই বাজেটে অনুপস্থিত। গতানুগতিক চিন্তার বাইরে কোন পদক্ষেপই নেই।

সবশেষে যে বিষয়টি  বিশেষভাবে বিবেচ্য তাহলো  এই জরুরি পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তা বলয় তৈরি । সমাজকল্যান বিষয়ে এবার বাজেট বরাদ্দ ৯,১২৫ কোটি, । গত বছরের তুলনায় সামান্য বেশী। কিন্তু ইতিমধ্যেই কোটি কোটি মানুষ করোনার আঘাতে যখন দ্রুত দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাচ্ছে, তখন সামাজিক নিরাপত্তা বলয় একটি অপরিহার্য ব্যবস্থা হয়ে উঠতে হবে। কর্মহীন মানুষ, আক্রান্ত মানুষ তাঁদের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনেই সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বিস্তৃত করা জরুরি। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও তাতে বাড়তি বরাদ্দ, প্রকৃত অর্থে এই সহায়তা  যাতে জনগণের কাছে পৌঁছায় তাঁর কাঠামো বিন্যাস, শুধুমাত্র আমলাতন্ত্র নির্ভর ব্যবস্থা সে কতটা অকার্যকর তা জেনেও সে বিষয়ে কোন সৃজনশীল নির্দেশনা নেই। দ্রুত আক্রান্ত মানুষের কাছে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে যাওয়া, আক্রান্ত রোগীর কাছে চিকিৎসা নিয়ে যাবার পরিকল্পনা। দুঃস্থ আক্রান্তদের শুধু চিকিৎসা নয়, খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা। তাঁর জন্য সামাজিক ব্রিগেড  তৈরি করা এ সবগুলোই সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের অন্তর্ভূক্ত করে  নেওয়া অপরিহার্য । রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে তাকেও  সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের অন্তর্ভূক্ত করা অবশ্য করণীয়।  

জরুরিভিত্তিতে স্থানীয় ‘লকডাউনের’ ব্যবস্থা রাখা এবং লকডাউন এলাকায় জরুরি চিকিৎসা, খাবার ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য পৌঁছে  দেবার ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এগুলোও এর আওতাধীন। কিন্তু বাজেটে এর কোন ইংগিত বা নির্দেশনা নেই।

বলা হচ্ছে এ বাজেট ব্যবসায় বান্ধব, শিল্প বান্ধব। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ এবং দিক নির্দেশনায় যে প্রকৃত চিত্র পাওয়া তাতে  এ বাজেট প্রকৃত অর্থে ‘ব্যবসায়ী বান্ধব’,ও  ব্যক্তি মালিকানা বান্ধব।

বৈশ্বিক অতিমারি মোকাবিলা করে জীবিকাকে অক্ষুণ্ণ রাখার কোন পরিকল্পনা চিত্রই এই বাজেটে দৃশ্যমান নয়। বিগত বছরের বাজেটে প্রত্যাশা  ছিল অকস্মাৎ এসে পড়া অতিমারির প্রেক্ষিতে জরুরি এবং বিশেষ বাজেট যা ‘জীবন ও জীবিকা’ রক্ষা করবে।  বাস্তবে তার প্রতিফলন হয়নি। গত বাজেট দারিদ্র রোধ করতে পারেনি। এ বাজেটও গত বছরের বাজেটের প্রতিলিপি, সংখ্যার পরিবর্তন ছাড়া। দর্শন ও দিক নির্দেশনার দিক দিয়ে এ বছরের বাজেটে গত বাজেটের কোন পর্যালোচনাও নাই, নতুন প্রস্তাবনাও নাই । বাজেট বরাদ্দের দিকে লক্ষ্য করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় এ বাজেট অতি ধনী ও আমলাদের তোষণ ছাড়া বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে জনবান্ধব বাজেট নয়। রাষ্ট্রিয় মালিকানা অবহেলিত, ব্যক্তিমালিকানার প্রধান ভিত্তি এবং তাঁদের প্রনোদনাই প্রাধান্যে । এমন কোন প্রস্তাবনা নেই যা আশু বা  দূরবর্তী  পরিকল্পনার দিক দিয়ে   দেশের সংবিধান নির্দেশিত পথের সমার্থক। স্পষ্টতঃই  বরং তার বিপরীত। তাই জন বান্ধব করার প্রস্তাবিত বিকল্পগুলির ভিত্তিতে এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বরাদ্দ জনমুখী করতে হবে,  না হলে যতই বাগাড়ম্ব্র করা হোক, সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। নীরব দুর্ভিক্ষ পায়ে পায়ে এগিয়ে আসবে। 

লেখক: পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

সর্বশেষ