রবিবার,৯,নভেম্বর,২০২৫
26 C
Dhaka
রবিবার, নভেম্বর ৯, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়মুক্তমতকমরেড গোলাপের মৃত্যু বামপন্থী রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি : ...

কমরেড গোলাপের মৃত্যু বামপন্থী রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি : বিদায় কমরেড! 

গণমানুষের নেতা কমরেড আমিনুর রহমান গোলাপ অশ্রুসিক্ত নয়নে অন্তিমশয্যা নিলেন: বামপন্থী রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি : বিদায় কমরেড! 
 
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিব্যুরোর সদস্য,  জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতি এবং গাইবান্ধার গণমানুষের নেতা কমরেড আমিনুর রহমান গোলাপ গত শুক্রবার গাইবান্ধায় অশ্রুসিক্ত নয়নে সমাহিত হলেন। তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে  তাঁকে রংপুরে  হাসপাতালে ভর্তি করা হয়; কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে এয়ার অ্যম্বুলেন্সে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করা হয়। দূর্ভাগ্যবশত তিনি ঢাকায় পৌছার আগেই ২২ অক্টোবর পথে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর আকস্মিক প্রয়ানে তাঁর পার্টির সহযোদ্ধারা শোকাভিভূত হন এবং আত্মীয় স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।  তাঁর পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ থেকে, জাতীয় কৃষক সমিতির পক্ষ থেকে,  যুব ও ছাত্র মৈত্রীর পক্ষ থেকে, নানান শ্রমিক সংগঠন থেকে  প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর মরদেহে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করা হয়।  তাঁর সন্তানের আগমন নিশ্চিত করে তাঁকে গাইবান্ধায় পার্টি কমরেড,  আত্মীয়,  বন্ধু,  সহযোদ্ধা,  সংস্কৃতিকর্মী  এবং নানা শ্রেণি পেশার মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) জানাজা শেষে সমাহিত করা হয়েছে। 
 
কমরেড আমিনুল ইসলাম গোলাপ পেছনে ফেলে গেলেন এক বর্ণাঢ্য  রাজনৈতিক জীবন। দুঃখজনক হলো তিনি এমন এক রাজনৈতিক সময়ে চলে গেলেন যখন তাঁর মতো অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতার প্রয়োজন ছিল।  কারণ,  তাঁর সারাজীবনের সংগ্রামের ফল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ বিপন্ন, গনতন্ত্র,সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আজ সংকটের মুখে, তাঁর দীর্ঘ জীবনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ও কমরেড রাশেদ খান মেনন আজ মিথ্যা মামলায় কারাগারে! 
 
কমরেড আমিনুল ইসলাম গোলাপ, এই কিছু দিন আগেও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশের কৃষকদের দাবি নিয়ে পুনরায় কৃষক সংগ্রাম তৈরি করার জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক অর্জনগুলোকে রক্ষা করে জনগণের মধ্য থেকে  প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।  তাঁর ছিল সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন।
 
সংক্ষেপে বলা যায়, কমরেড গোলাপ  ১৯৪৭ সালে গাইবান্ধায় জন্মগ্রহন করেন এবং নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন I তিনি গাইবান্ধা  ইসলামিয়া হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৩ সালে এসএসসি পাস করেন l পরে গাইবান্ধা কলেজে এইচএসসি পাশ করে  জগন্নাথ কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করেন l এই সময়ও তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেনl তিনি মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, ইউপিপি হয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন।  তিনি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।  l 
 
২০১৬ সাল থেকে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির  পলিটব্যুরোর  সদস্য নির্বাচিত হন l অন্যদিকে তিনি ২০১০ সাল পর্যন্ত গাইবান্ধা জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন l একই সাথে তিনি  জাতীয় কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক  ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন l তিনি মওলানা ভাসানী ও রাশেদ খান মেননের অনুপ্রেরণায় কৃষক সংগঠনকে গুরুত্ব দিতেন। তাঁর নেতৃত্বে  ৯০ এর দশকে গাইবান্ধায় খাস জমির আন্দোলন তীব্র হয় l  তিনি তখন ডিপটিউবলের ঋণ মওকুফের আন্দোলন করেছিলেন এবং সফল হন। আন্দোলনের ফলে কৃষকদের ঋণ মওকুফ হয়েছিল l তিনি গাইবান্ধা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন l গাইবান্ধার কয়েকটি সমস্যা সমাধানে তিনি সাহস ও নিষ্ঠার সাথে ভূমিকা রেখেছিলেন l তিনি গাইবান্ধা নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সভাপতিও ছিলেন l তিনি সামাজিক আন্দোলনেরও নেতা ছিলেন। বখাটদের নির্যাতনে স্কুল ছাত্রী ত্রিশা পুকুরে পড়ে মারা গেলে একটা বড় আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং তাতে বখাটেদের শাস্তি হয়েছিলl তিনি  গাইবান্ধা জেলার সাতটি উপজেলায়ই পার্টি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। পার্টি জীবনে তিনি রাজনৈতিক নীতি ও আদর্শের বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতেন। কাজী   জাফর আহমদের সাথে  চীন ভ্রমণ করলেও  তিনি  তাঁর সাথে রাজনৈতিক পার্থক্যের পর আর একসাথে পার্টি করেননি। 
 
বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নানান ভাঙনের মুখেও তিনি পার্টি ভাঙার পক্ষে থাকতেন না।  তিনি পার্টির ঐক্য ও শৃঙ্খলার পক্ষে থাকতেন।  আমি ব্যক্তিগতভাবে কমরেড আমিনুল ইসলাম গোলাপের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আহবানে চীন ভ্রমণ করেছি।  সেই ভ্রমণেও দেখেছি তিনি পার্টির শৃঙ্খলা, পার্টির নীতি, মাও সে তুঙের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা এবং মার্কসবাদের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ।  সেই ভ্রমণকালে তিনি খুব আক্ষেপ করেছিলেন মাও সে তুঙের মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে না পারায়। তখনো তিয়েনআনমেন স্কোয়ার বিদেশি ভিজিটরদের জন্য বন্ধ ছিল। 
 
আমি তাঁর আমন্ত্রণে একবার  গাইবান্ধা গিয়েছিলাম এক দিনের প্রশিক্ষণ ও আলোচনায় অংশ নিতে। আমি দেখেছি তিনি ছিলেন পলাশবাড়ী থেকে গাইবান্ধা সদর বা সকল উপজেলার গণমানুষের জননেতা। 
অনেকে মনে করেন,  মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক নেতারা জনপ্রিয় বা জননেতা নন কিন্তু কমরেড আমিনুল ইসলাম গোলাপ ছিলেন তার ব্যতিক্রম। কমরেড গোলাপ ছিলেন সত্যিকারের কৃষক,  শ্রমিক,  ক্ষেতমজুর,  দিনমজুর ও মধ্যবিত্তের নেতা। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা, চিনিকল শ্রমিকদের নেতা, তিনি ছিলেন আদিবাসীদের নেতা; তিনি ছিলেন গাইবান্ধার সকল গনতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক দলসমূহের  নেতা। তিনি ছিলেন গাইবান্ধার একজন গণমানুষের  নেতা। গণমানুষই ছিল তাঁর সকল আন্দোলনের শক্তি। 
 
বাংলাদেশ আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।   এক নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে।অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্র গভীর সংকটে পড়েছে।  এই সংকট থেকে পরিত্রাণে  তাঁর অভাব আমরা অনুভব করবো।
কমরেড আমিনুল ইসলাম গোলাপের মৃত্যু শুধু বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির অপূরণীয় ক্ষতি নয়- এই ক্ষতি সমগ্র বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনেরও এক অপূরণীয় ক্ষতি।  তাঁর মৃত্যুর শোক বইবার নয়। তবুও মৃত্যু এক অমোঘ সত্য। এটা মেনে নিয়েই  তাঁর জীবনের শিক্ষাকে অনুসরণ করাই হবে আমাদের কর্তব্য। বিদায় কমরেড আমিনুল ইসলাম গোলাপ।  লাল সালাম।
 
 
লেখক- শরীফ শমশির 
লেখক ও গবেষক 
 
 
 
 
 
 
 
 

সর্বশেষ