করোনাকালে পড়া তিনটি বই:রাশেদ খান মেনন

করোনাকালে গৃহবন্দী থাকার মধ্যে কুফল যেমন ছিল, তেমনি সুফলও ছিল। ছিল বলছি এ কারণে যে, বছরের শেষের দিকে ভ্যাকসিন পাবার আশার কথা বলেছে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা। তা’ছাড়া গবেষণায় বলেছে ঢাকা মহানগরের ৪৫% ভাগ লোকের মধ্যে করোনার এন্টিবডি তৈরী হয়েছে। সেটা হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছেছে কিনা এ নিয়ে কথা না বললেও সাধারণভাবে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ কমে এসেছে। শীতে নতুন ঢেউ না এলে ভ্যাকসিনের কল্যাণে গৃহবন্দীত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি মিলবে। ভ্যাকসিন সবার না জুটলেও আমাদের বয়সীরা অগ্রবিবেচনা পাব বলেই ধারণা। ফলে নতুন বছরের শুরুতে স্বাভাবিক জীবনে (নতুন স্বাভাবিকতা?) ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনায় মনটা উৎফুল্ল।
তার চেয়েও উৎফুল্ল বোধ করছি করোনাকালে বাধ্যগত অবসরে আত্মসমীক্ষার সুযোগ পেয়ে। এই আত্মসমীক্ষা যেমন নিজের ব্যক্তিজীবনের, তেমনি রাজনৈতিকজীবনের। করোনার এই অবসরের সুযোগ পেয়ে সেই জীবনের একটি পর্যায়ের কথা লিখে ফেলেছি। সেটা স্বাধীনতার অর্জনের সময় পর্যন্ত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তা প্রকাশ করতে পারলে করোনাকেই ধন্যবাদ দিতে হবে। তার চাইতে বড় কথা এই সময়কালে ঐ আত্মসমীক্ষা করতে গিয়ে বেশ কিছুু প্রাসঙ্গিক বই পড়ে ফেলেছি। ভারী পাÐিত্যপূর্ণ কোনো বই নয়, বন্ধু কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর সাদামাটা ভাষায় লেখা কয়টি বই পড়ে নিজেকে খুজে পাচ্ছিলাম। মনে হয়েছে বইগুলো সম্পর্কে এদেশের নতুন প্রজন্মকে জানানো প্রয়োজন। তাদের পড়ানো প্রয়োজন। এমনিতেই নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের (বেশ কিছু ব্যতিক্রম বাদে অবশ্যই) ইতিহাস ভুগোল জ্ঞান কম। এটা তাদের দোষ না। স্কুল-কলেজের পাঠক্রমে সমাজপাঠে ইতিহাস-ভুগোল-রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কে যে ধারণা দেয়া হয় তাতে তাদের ঐ দুই বিষয় সম্পর্কে গভীরে যাওয়া দূরের কথা, খুব একটা সাধারণ ধারণাও হয় না। অবস্থাটা এমনই ছিল যে কলেজ পর্যায়ের দেশ-বিদেশের ইতিহাস তো দূরের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসটাও পর্যন্ত পড়ানো হত না। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকার সময় দেশের কিছু স্বনামধন্য ইতিহাসবিদরা যে প্রচেষ্টা নেন তাকে আমি সমর্থন দেই। তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান উপচার্যের উদ্যোগে বিশ^বিদ্যালয়ের কলেজ পর্যায়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বাধ্যতামূলক বিষয় করা হয়। কিন্তু তারপরও দেশের কলেজ পর্যায়ে ইতিহাসের ছাত্র পাওয়া যায় না। ভুগোলের কথা সেভাবে বিশেষ বলতে না পারলেও অবস্থা এর চাইতে ভাল না। বিসিএস পরীক্ষার সময় কোচিং বই আছে তাই তারা পড়ে নেয় ঐ পরীক্ষার নম্বর পাওয়ার জন্য। আর এখন আর এক সুবিধা হয়েছে এই যে গুগলে সার্চ দিলেই ইতিহাস-ভুগোল সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লাইব্রেরী, বইও এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে সহজলভ্য। কিন্তু সে কষ্টটুকু ব্যতিক্রমবাদে বড় কেউ একটা স্বীকার করতে চায় না।
আর কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে ইতিহাস ভুগোলের জ্ঞান কত প্রয়োজন নয়াচীনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাও সেতুং সেটা বলে গেছেন। তিনি চীনের পার্টি কর্মীদের দেশের একশ বছরের ইতিহাস ও দেশের ভুগোল সম্পর্কে জানার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে কমিউনিস্ট ও বাম কর্মীদের এসব ব্যাপারে জ্ঞানের পরিধি খুবই সীমিত। এর প্রধান কারণ ছোটবেলা থেকে তারা যা পড়ে এসেছে। যা সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে, সেটা তাদের ঐ জ্ঞান, শত্ত দূরে থাক, সাধারণ ভিতের উপরেও দাঁড় করায় না। তার চেয়ে বড় কথা সমাজতান্ত্রিক কর্মী হিসাবে সমাজ বিকাশের ধারা, সমাজের মধ্যকার দ্ব›দ্ব ও তার বিকাশ সেই গোড়া থেকে সমাজবিপ্লবের ইতিহাস, তার উত্থান-পতন এবং সর্বোপরি ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তা দেখার জন্য যে ষ্ট্রাকচার বা পাঠকাঠামো প্রয়োজন তা প্রায় সব কমিউনিস্ট ও বাম দলে অনুপস্থিত বা উপস্থিত থাকলেও তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। দু’একটি দল বা দু’একজন ব্যক্তি এতে আপত্তি করবেন। তারা বলবেন আমাদের খুবই ষ্ট্রাকচার্ড পাঠচক্র আছে। তার যথাযথ অনুশীলনও হয়। কিন্তু একটু আচড়ালেই তার অন্তঃসারশুন্যতা বেরিয়ে আসবে। আবার বলছি এটা সাধারণ অবস্থা। ব্যতিক্রম সবকালে ছিল এখনো আছে।
আমাদের সময়ের কথা বলি। তখন ঘোর সামরিক শাসন। পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত সময়জুড়েই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। নিষিদ্ধ ছিল কমিউনিস্ট সাহিত্য অথবা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার কোনো বই, পত্র-পত্রিকা সবই। আমার মনে আছে আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ’৫৪ নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দিয়ে দেশের ৯২-ক ধারায় কেন্দ্রীয় শাসন জারি হয়েছে। আমাদের ময়মনসিংহের বাসায় বড় ভাইদের সংগ্রহের মার্ক্সবাদী ও বামপ্রগতিবাদী ধারার যে বইপত্র ছিল আমার জেলা জজ পিতা সেগুলো বের করে পুড়িয়ে ফেলেন। বড় ভাইরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টি, তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে বাষট্টির দিকে এসে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের ধাক্কায় সামরিক শাসনে বরফ গলা শুরু হয়েছে তখন যে মার্ক্সবাদ শিক্ষার বইদিয়ে আমাদের হাতেখড়ি তার নাম দিল ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’ বন্ধু রনোর কলকাতার নানাবাড়ীর সুবাদে সে কলকাতা বেড়াতে গেলে লুকিয়ে ছাপিয়ে কিছু মার্ক্সবাদী বই আনত। সেসব কখনো আমার হাতে এসেছিল কিনা মনে করতে পারছি না। তবে যে বইটা প্রথম হাতে পেয়েছিলাম সেটা ছিল অনিল মুখার্জীর লেখা ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’। তাও পুলিশের হাতে ধরা পরার পর আইবি অফিসের টয়লেটে ছিঁড়ে ফেলে ফ্লাস করে দিয়েছিলাম। তবে ’৬৪টি’র জেলখানা আমার জন্য বড় শিক্ষালয় ছিল। পুরানা সব কমরেডরা ছিলেন, যারা মার্ক্সবাদ পড়তে ও বুঝতে সাহায্য করেছিলেন। এর বাইরে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ রাহুল সংস্কৃতায়নের বইগুলো ছাড়াও জেল লাইব্রেরী পুরান রাজবন্দীদের দান করা ‘রেডস্টার, ওভার চায়না’, ‘ফরম কপিয়াম ওয়ার টু লিবারেশন’ জাতীয় বই পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বস্তুতঃ ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলের প্রথমভাগে জেলখানা ছিল কমিউনিস্ট কর্মীদের শিক্ষালয়। ষাটের দশকের মধ্যভাগে এসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাথে সম্পর্কোন্নত করলে মস্কোর প্রগতি প্রকাশন ও চীনের ‘গৌজী সুদিয়ানের’ প্রচুর বই, বেইজিং রিভিউ, মস্কো টাইমস পত্রিকা এদেশে আসতে শুরু করে। কিন্তু তদ্দিনে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিতর্ক-বিভক্তির ধারা শুরু হয়েছে। ঐ সময়ে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার মূল ভিত সম্পর্কিত বইগুলো আসলেও, প্রধান যে সব বই তরুণ কর্মীদের আকর্ষণ করত তা হল পলেমিকাল বা বিতর্কমূলক বই। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিতরকার বিতর্ক। আর একটু সময় এগুতে যখন মস্কো-পিকিং বিভক্তি ঘটে গেছে তখন সোভিয়েত সাহিত্যের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ-শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা, পুঁজিবাদী পথ এড়িয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ, শ্রেণী রাষ্ট্রের বদলে জনগণের রাষ্ট্রের তত্ত¡ প্রভৃতি। অন্যদিকে চীনের সাহিত্যে প্রথম দিকে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী আদর্শকে উর্ধ্বে তুলে ধরা হলেও, সাংস্কৃতি বিপ্লবের পর তা ‘লালবই’ আর মাও সেতুং-এর কোটেশনে রূপ নেয়। সেসব মুখস্ত করে ও উদ্ধৃত করে কথা বলে যখন কমিউনিস্ট বিপ্লবী হওয়া যেত তখন কমিউনিস্ট আদর্শের মূল সাহিত্য পড়ার প্রয়োজন অনুভূত হোত না।
বাংলাদেশ পরবর্তীকালে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ, সোভিয়েত বিপ্লব, চীন বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক পুণর্গঠনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তরুণদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারার, তরুণদের বড় অংশ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র শ্লোগানে ‘বিপ্লবের স্বপ্ন’ নিয়ে এগুতে থাকে। কিন্তু ঐ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কোনো তাত্তি¡ক ভিত্তি ছিল না। প্রয়োগিক দিকও ছিল ভ্রান্ত। ফলে শিঘ্রই তা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আশির দশকে এসে মার্ক্সসবাদ নিয়ে তরুণদের মধ্যে চর্চা শুরু হয়। অবশ্য যে কথাটা বলতে ভুলে গেছি তা হল বাংলাদেশ পরবর্তীতে সিপিবি ও মোজাফ্ফর ন্যাপের কর্মীদের সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হত মার্ক্সবাদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য। তবে সে জ্ঞান অর্জন যেকোনো কাজে লাগেনি তার প্রমাণ ঐসব নেতা-কর্মীদের অধিকাংশের কমিউনিস্ট মতবাদ পরিত্যাগের ঘটনায়। চীনও নকশালপন্থী ধারার নেতা-কর্মীদের নিয়ে তাদের দেশে মাস-দু’মাস রেখে তত্ত¡ ও প্রয়োগের জ্ঞানদানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ভদকা মাওতাইয়ের ধ্বংস সাধন হয়েছে মাত্র। এসব ট্রেনিংপ্রাপ্ত মার্ক্সবাদী কেউই কোনো কিছু লিখেছেন বলে নজরে আসেনি। বরং মস্কোতে যারা লেখাপড়া করতে গিয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই মাক্সবাদী অর্থনীতি, সমাজতত্ত¡ প্রভৃতি সম্পর্কে তাদের মেধার পরিচয় দিয়েছে। তবে তারা দেশে ফিরে এসে আর কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সেভাবে যুক্ত থাকেনি।
ইতোমধ্যে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটেছে। পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবি ও ইতিহাসবিদরা তাকেই সমাজতন্ত্রের ইতি বলে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। বলেছে পুঁজিবাদই ইতিহাসের শেষ সত্য। অন্যদিকে বিশ^ রাজনীতিতে অবস্থান নিতে গিয়ে চীনের ‘অতিবামমোড়’ বাংলাদেশে কেবল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনেও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, একটি প্রজম্মের ধ্বংস সাধন করেছে। পরবর্তীতে চীনের স্বপথে ফিরে আসার পাশাপাশি তার ‘উম্মুক্তকরণ’ ও ‘সংস্কার’ নতুন নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। চীন অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্টির নেতৃত্ব, তাত্তি¡ক ও সাংগঠনিক শুদ্ধুতার উপর জোর দিচ্ছে, চীনের পার্টি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে কিন্তু এখনো বিশ^ কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভ্রান্তি কাটেনি।
ইতোমধ্যে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিপর্যয়, বিশ^ায়ন, প্রভৃতি প্রশ্ন বিশ^ কমিউনিস্ট আন্দোলনকেই অনেক নতুন বাস্তবতায় মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির বিপুল উন্নতি ও তার প্রভাব, আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্ড, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিশ^ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনে আরও সব নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। উৎপাদন শক্তির সাথে উৎপাদন সম্পর্কের দ্ব›দ্ব নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এসবের উত্তর খুজে পাওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু তার জন্য মার্ক্স’র কাছে, লেনিনের কাছে ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে সমাজবিকাশের যে ধারা সামন্ত সম্পর্ক থেকে পুঁজিবাদী সম্পর্কে উত্তরণ ঘটিয়েছে, উত্তরণ ঘটিয়েছে পুঁজিবাদের থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সাম্যবাদী সমাজের পথযাত্রায় পর ইতিহাস জানতে হবে। জানতে হবে নিজ দেশকে, নিজ দেশের ইতিহাসকে। এটা একটা লম্বা তালিকা (ষড়হম ষরংঃ)। কিন্তু তাও সহজভাবে তুলে ধরলে বুঝলে সেই জ্ঞান নিজ দেশের বাস্তবতায় প্রয়োগ কিভাবে হতে পারে সেই ধারণার সৃষ্টি হলে খুব একটা গুরুভার কিছু হবে না। কমরেড রনোর তিনটি বই ‘ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’, ‘দুইখÐে পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ তার নির্যাসই তুলে ধরেছে অত্যন্ত সহজ পাঠ্যভাবে। আবার ঐ বই থেকেই মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের মূল সূত্রগুলোর সন্ধান কিভাবে পাওয়া যাবে তার নির্দেশও আছে। অবশ্যপাঠ্যগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণও আছে। বিবরণ আছে সমাজ বিকাশের ইতিহাসের। বিবরণ আছে শ্রেণীদৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস, সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতির পাঠের। সেকথাই এখন বলব। প্রথম বইটি ‘ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব’। ফরাসী বিপ্লবকে আমরা সাধারণভাবে জানি সাম্য ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা-মন্ত্রে উবৃত্ত বিপ্লব হিসেবে। সেই বিপ্লব স্মরণে ১৪ই জুলাই ফরাসী দেশে জাতীয় উৎসব হয়। কিন্তু এটা ফরাসীদের জাতীয় উৎসবই নয়, ইতিহাসের নতুন উত্তরণ হিসাবে বিশে^র মানুষের উৎসবের দিন। ফরাসী বিপ্লব সামন্তবাদের গর্ভ থেকে পুঁজিবাদের জন্মধাত্রী ছিল। আবার ঐ পুঁজিবাদের ভ্রণের মধ্যেই জন্ম নেয়া শ্রমিকশ্রেণীর আরেকটি যে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল একই দেশে যা ইতিহাসে ‘প্যারী কমিউন’ নামে খ্যাত এবং মার্কস যার মধ্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম উন্মেষ দেখেছিলেন। সে সম্পর্কে বুর্জোয়া ইতিহাস সাধারণভাবে নিরব। নিরব আমাদের দেশের ইতিহাসও। কমরেড রনো কেবল ফরাসী বিপ্লব বা প্যারিকমিউনের ইতিহাসই বিবৃত করেননি। সে সময়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশের পুঁজিবাদের বিকাশ, শ্রমিকশ্রেণীর বিকাশ, তাদের আন্দোলনের বিকাশ, উত্থান পতন, দর্শনে নব নব আবিস্কারসমূহ খুবই সাধারণভাবে তুলে ধরেছে। তুলে ধরেছেন কিভাবে মার্কস ও তার বন্ধু এঙ্গেলস ভাববাদকে খÐন করেছেন, আবার হেগেলের বস্তুবাদী চিন্তাকে বিকশিত করেছেন। ইতিহাসের বস্তুবাদী প্রয়োগে সমাজ বিকাশ ধারাকে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন কিভাবে সমাজ বিকাশের গতিধারায় পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেছে, সাম্যবাদী পথযাত্রার উন্মোচন ঘটেছে। আর এর ধাদ্রী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টি জন্ম দিয়েছেন, এগিয়ে নিয়েছেন। এই যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। দর্শন নিয়ে বিতর্ক-বিবাদ হয়েছে। বিতর্ক-বিবাদ হয়েছে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের পথ নিয়ে। মার্কস পুঁজি’র চেহারা উন্মোচন করেছেন তার জগৎ বিখ্যাত ‘ডাস ক্যাপিটেল’ বইয়ে। এঙ্গেলস মার্কসের রেখে যাওয়া নোটস নিয়ে ঐ ‘পুঁজি’ গ্রন্থের বাকী খÐগুলোকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন।
এভাবেই জন্ম নিয়েছে মার্কসবাদ। রচিত হয়েছে কমিউনিস্ট ইশতেহার। গঠিত হয়েছে কমিউনিস্ট সংগঠন। কিভাবে পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ঘটবে সে সম্পর্কেও বিস্তারিত যা লিখে গেছেন মার্কস (ও তার সাথী এঙ্গেলস) তার সংক্ষিপ্ত সার উপস্থাপন করেছেন রনো অত্যন্ত প্রাজ্ঞলভাবে যা মার্কসবাদের বিশাল পরিধিকে সকলের কাছে সহজবোধ্য করে তোলে। কিন্তু রনো সেখানেই থেমে যাননি। মূল বইগুলোর কথাও তুলে ধরেছেন যাতে কেউ সেই সূত্র ধরে তার অধ্যয়ন করতে পারে। তাকে আত্মস্ত করতে পারে।
এরপর রনো দেখিয়েছেন কিভাবে লেনিন মার্কসবাদের বিকাশ ঘটিয়েছেন। রুশ দেশের বাস্তবতায় তার প্রয়োগ ঘটিয়ে বিপ্লব সাধন করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে লেনিনবাদেÑযা সা¤্রাজ্যবাদের যুগে মার্কসবাদ।
অক্টোবর বিপ্লব সংঘটনে যে বিভিন্ন পর্যায়কাল অতিক্রম করতে হয়েছিল, এজন্য লেনিনকে কি কঠিন ও তীক্ষè মতাদর্শগত লড়াই করতে হয়েছে তার বিবরণ পাই অক্টোবর বিপ্লবের ঘটনাক্রমের বিবরণে। রনো তার এই বইয়ে লেনিনের কিছু প্রয়োজনীয় বইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেছেন নতুন পাঠকদের সাধারণ ধারণার জন্য। এর সূত্র ধরে তারা লেনিনের মূল্যবান লেখাগুলো পড়তে আগ্রহী হবে এবং যারা পার্টির পাঠক্রম পরিচালনা করেন তারা এ সকল রেফারেন্সকে ব্যবহার করতে পারেন।এই গুরুত্বপূর্ণ বইটির সাথে সংযুক্ত না হলেও একজন কমিউনিস্ট কর্মীর নিজ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানা জরুরি। আর প্রথম বইটা পড়লে তার যে দৃষ্টিভঙ্গি জন্মাবে তা দিয়ে নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবে। উপলব্ধি করতে পারবে দেশের মানুষের সংগ্রামকে। সমাজ অর্থনীতির অগ্রগতিকে। একইসঙ্গে তার মধ্যে উপলব্ধি জন্মাবে নিজ দেশের সমাজ বিকাশ সম্পর্কে। সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরণকে। কমরেড রনোর দুই খÐের এই বইয়ের পলাশীর যুদ্ধ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পথ পরিক্রমাকে বিবৃত করেছেন। এই পথ পরিক্রমায় নায়ক-খলনায়কদের চিত্রিত করেছেন। সবচাইতে বড় মানুষের সংগ্রামগুলোকে প্রতি সময়ের বাস্তবতার আলোকে তুলে ধরেছেন। আর এসবই তিনি করেছেন শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। দেশের নতুন প্রজন্ম এই দু’খÐের মধ্য দিয়ে নিজ দেশকে চিনবেন, দেশের মানুষকে চিনবেন, জানবেন নিজ ঐতিহ্য। আর তাই তাকে দেশকে আরও ভালবাসতে শেখাবে। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াইয়ে তাকে আরও দক্ষ ও যোগ্য করে তুলবে।
আমি আশা করব আমাদের দেশের কমিউনিস্ট কর্মীদের গড়ে উঠতে এই তিনটি বই কেবল সহায়ক হবে না, দেশ ও দেশের মানুষদের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। তিনটি বই পাঠ করুন এই প্রাথমিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করুন।
লেখকঃ বর্ষীয়ান বামপন্থী নেতা ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।
নতুন কথা প্রতিবেদন:সড়কের শৃঙ্খলা কিভাবে ফেরাতে হয় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিশোর আন্দোলন। সেই আন্দোলনের চাপে বাধ্য হয়ে সংসদে পাস করা হয় নিরাপদ সড়ক আইন-২০১৮। গত বছরের নভেম্বরে তা কার্যকর করা হলেও এখনো তার প্রয়োগ লক্ষ করা যায় না। বরং অনেকটা চাপে আছে সরকার কর্তৃক কার্যকর করা ওই আইন। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা, বাড়ছে লাশের মিছিল। গাড়ীর বেপরোয়া চলাচল এখনো বন্ধ হয় নি। দূর হয় নি পরিবহন খাতের নৈরাজ্য। আজো নিরাপদ হয় নি যাত্রী, চালক ও পথচারীর জীবন। ফেরে নি সড়কের শৃঙ্খলা। এরই মধ্যদিয়ে ২২ অক্টোবর পালিত হলো ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’।
‘মুজিব বর্ষের শপথ, সড়ক করব নিরাপদ’-এই প্রতিপাদ্যে পালিত সড়ক দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালকরা মাদক সেবন করে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ‘ডোপ’ টেস্টের নিদের্শনা দিয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনও পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সড়কে শৃঙ্খলা ফেরে নি। বরং সড়কেও বিশৃঙ্খলা আরো বেড়েছে। সড়কে গাড়ি বেড়েছে কিন্তু চালক বাড়ে নি। উল্টো গাড়ি বাড়ার সাথে সাথে বৈধ চালকের সংখ্যা কমেছে। আর এ ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ(বিআরটিএ) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই।
বিআরটিএ’র যাত্রা শুরু ১৯৮৭ সালে। তখন যানবাহন ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার। চালক ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার। অর্থাৎ গাড়ীর চেয়ে চালক বেশি ছিল ১৫ হাজার। কিন্তু গত ৩৩ বছরে নিবন্ধতি গাড়ির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখের ওপরে। কিন্তু চালকের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৫ হাজার। যানবাহনের তুলনায় চালকের সংখ্যা কম আছে ১৮ লাখ। এছাড়া নিবন্ধন ছাড়া গাড়ির সংখ্যা তো আছেই। এর ফলে পরিবহনে শ্রমিকদের কর্মঘন্টা মানা হচ্ছে না। একজন শ্রমিক বেশি টাকার আশায় বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালিয়েই যাচ্ছে। বাড়ছে দুর্ঘটনা। শ্রম আইন অনুযায়ী একজন চালক একটানা সর্বোচ্চ ৫ ঘন্টা এবং সারা দিনে ৮ ঘন্টা গাড়ি চালাতে পারবেন। ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রী পরিষদ বৈঠকে চালকদের কর্মঘন্টা মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং বিশ্রামাগার নির্মাণের নির্দেশনা দেন। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল পরিবহন মালিকদের। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না।
গত ৫ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৭ হাজার ১৭০ জন। আর আহত হয়েছেন ৮২ হাজার ৭৫৮ জন। মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। তারপরেও সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বিআরটিএ’র জনবল কাঠামো সঙ্কটের কারণে চালকের লাইসেন্স দিতে সময় লাগছে। অন্যদিকে তরিঘড়ি করে পরীক্ষা নিয়ে লাইসেন্স দিতে হয়। কারণ একজন মোটরযান পরিচালক চালকের পরীক্ষা নিতে খুবই কম সময় পান। অন্যদিকে চাপ থাকে পরিবহন শ্রমিক মালিক সমিতির নেতাদের চাপ।
এছাড়া বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবহন নেতারা আন্দোলন ডেকে সড়ক অচল করার হুমকি দেয়। এই ভয়ে নতুন সড়ক আইন পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না। ফিরছে না সড়কের শৃঙ্খলা। বন্ধ হচ্ছে নিহত ও আহতের মিছিল। নিরাপদ সড়ক দিবসে তাই সকলের প্রত্যাশা প্রতিপাদ্যের দিকে খেয়াল রেখে সরকার অবশ্যই সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সকল প্রকার চাপ ও আন্দোলনের ভয় উপেক্ষা করে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং মৃত্যুর মিছিল থামাতে আরো কঠোর হতে হবে-এমন প্রত্যাশা যাত্রী, পথচারী ও সাধারণ মানুষের।