Site icon নতুন কথা

কার্ল মার্ক্স- এর শ্রেণীচ্যুতিঃ মানুষের র্মযাদা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম

।। আজিজুর রহমান আসাদ ।।

আজিজুর রহমান আসাদ

১৮৪২ সালে কার্ল মার্ক্স অনেকগুলো নিবন্ধ লিখেন, বনে পড়ে থাকা শুকনো কাঠ কুড়ানো নিয়ে। এই কাঠ কুড়ানোর আইনি অধিকার নিয়ে ঐ সময়ে রাইনল্যান্ড প্রভিন্সিয়াল এসেমব্লিতে বিতর্ক হচ্ছিল। মার্ক্সের নিবন্ধের নাম ছিল, “কাঠ চুরি বিতর্ক।”
এই নিবন্ধসমূহে মার্ক্স ‘দরিদ্র বনাম নাগরিক সমাজ’ এর পার্থক্য ও চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেন। এই আলোচনার চিন্তাসূত্রেই মার্ক্স পরবর্তীকালে সর্বহারা শ্রেণী বা প্রলেতারিয় শ্রেণী ধারনা বিস্তারিত ভাবে অনুসন্ধান, বিকশিত ও ব্যাখ্যা করেন।
হেগেলের দর্শন নিয়ে মার্ক্সের ভাবনার রূপান্তরের মুলে একটি আবেগগত বা নৈতিক পক্ষপাতিত্বের দিক আছে। হেগেল ‘দরিদ্র’ মানুষদের যেভাবে নেতিবাচক শব্দে প্রকাশ করেছেন, মার্ক্স তা পছন্দ করতে পারেননি।
হেগেল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে ‘দরিদ্র’ মানুষকে অভিধা দিয়েছেন, ‘মর্যাদাহীন’ বা ‘স্ট্যাটাস নেই’ এমন লোকদের। জার্মান ভাষায় মর্যাদাবান এর দ্বৈত মানে আছে। যারা মর্যাদাবান এরা একটি বর্গ, নাগরিক সমাজ, যারা আবার রাজনৈতিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে। হেগেল, এখান মর্যাদাবানদের, নাগরিক ও রাজনৈতিক এই দুই চরিত্রের ও ভূমিকার একটি ঐক্য বা সার্বজনীনতা দেখেন। ফলে, মর্যাদাহীনেরা বা দরিদ্ররা বিবেচিত হন, দার্শনিকভাবেই সর্বহারায়, নাগরিক সমাজের বাইরে।
হেগেল নাগরিক সমাজ বা মর্যাদাবান সম্প্রদায়কে তিন ভাগে কিন্তু একটি ঐক্যবদ্ধ চরিত্রে দেখেন। রাষ্ট্রের আমলারা হচ্ছে একটি অংশ, যাদেরকে ‘নাগরিক সেবক’ বলা হয়। এরপর জমিদার বা ভূস্বামী নামের মাননীয়েরা এবং তৃতীয় অংশ হচ্ছে ব্যবসায়ী শ্রেণী বা ‘কর্পোরেশন’ যা অতীতের ‘গিল্ড’ এর মত। ‘অধিকারের দর্শন’ বইতে কর্পোরেশন এর আলোচনায় হেগেল ব্যবসায়ীদের ব্যপারে মনোভাব খুব স্পষ্ট করেছেন। হেগেলের ভাষ্য মতেঃ
“একজন কর্পরেশোন সভ্যের (ব্যবসায়ীর) নিজস্ব সম্প্রদায়গত অবস্থান, তাঁর দক্ষতা, আয় ও সম্পদের বাইরে কোন প্রমাণের দরকার নেই যে সে কেউকেটা একজন বিশেষ ব্যক্তি। তাঁর সম্মান এই মর্যাদাবান অবস্থানের সাথে অবিভাজ্য।”
হেগেলের মতে, মর্যাদাবান নাগরিক সমাজে একজন ব্যবসায়ীর অবস্থান স্ব-প্রমাণিত এবং অবিভাজ্য। এই ক্ষেত্রেই একজন দিন মজুরের সাথে একজন নাগরিক সমাজের সভ্যের পার্থক্য। দিন মজুর আলাদা, সে না নাগরিক সেবক, না ভূস্বামী না ব্যবসায়ী। এই দিনমজুরদের হেগেল মর্যাদাহীন মনে করেন, নাম দিয়েছেন জার্মান ভাষায় ‘পোবেল’, আক্ষরিক অর্থে ভাঙ্গা চোরা নুড়ি পাথর। কাব্যি করে বলা যায়, ধূলিকণা। যা অতি তুচ্ছ, মর্যাদাহীন।
হেগেলের কাছে সম্মান বা মর্যাদা শুধু নাগরিক সমাজ তথা আমলা, ভূস্বামী জমিদার ও ব্যবসায়ীদের প্রাপ্য। কারণ আমরা হেগেলের কাছ থেকে আগেই জেনেছি। এরা সবাই সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী একটি বর্গের সভ্য। এই যে সম্পদের মালিকানায় নাগরিক সত্তা, এটি আইনি ভাবে সমর্থিত। কিন্তু দরিদ্রদের এই ধরনের কোন আইনি সমর্থিত মর্যাদা নেই, কারণ তাঁদের সম্পদের আইনি মালিকানা নেই। হেগেল এই আইনি স্বীকৃতিকে প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়েছেন। ফলে দার্শনিক ভাবে আসলে দরিদ্র মানুষেরা নাগরিক সমাজের সভ্য হিসবে “অস্তিত্বশীল” নয়।
কার্ল মার্ক্স, হেগেলের এই গোটা ধারনাটাকেই সমালোচনা করেন।
মার্ক্স হেগেলের সাথে একমত যে, দরিদ্র মানুষেরা ‘নাগরিক সমাজ’ তথা আমলা-ভূস্বামী-ব্যবসায়ী বর্গের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু তাঁরা ধ্বংসস্তূপের মর্যাদাহীন আবর্জনাও নয়। মার্ক্স এই দরিদ্র আইনি অধিকারবঞ্চিত বর্গের নাম দেন, “মানব সমাজের প্রাথমিক শ্রেণী”। ঐতিহাসিকভাবে এদের কোন আইনি মর্যাদা ছিলোনা এবং এখনো নেই।
ফিরে আসি “কাঠ চুরি বিতর্কে”।
মার্ক্স দেখান যে, জঙ্গলে পড়ে থাকা কাঠ কুড়ানো একটি “প্রথাগত অধিকার” বা কাস্টমারি রাইট। (এখনো আদবাসি সমাজে এই প্রথাগত অধিকারের মালিকানা ব্যবস্থা আমরা দুনিয়ার অনেক দেশেই দেখি।)
মার্ক্স উন্মোচন করেন যে, আসলে বিত্তবান ও ক্ষমতাবান শ্রেণী নিজেদের আইনি অধিকারকে “সার্বজনিন” হিসেবে দেখিতে ও দেখাতে বাধ্য করে। ফলে, বিত্তবান শ্রেণী বা হেগেল যে আইনের যুক্তি দিয়েছেন, সেটি ভুল। মার্ক্স এর মতে, বনের পড়ে থাকা কাঠের উপর প্রথাগত অধিকার সমগ্র দরিদ্র শ্রেণীর। দরিদ্র শ্রেণী মনে করে, এই কাঠ কুড়ানো কোন চুরি নয়, বরঞ্চ অধিকার। এই যে অধিকার সচেতনতা, মার্ক্স পরবর্তীতে এর নাম দেন শ্রেণী সচেতনতা।
মার্ক্স এর মতে, দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ যে কাঠ সংগ্রহ করছে, এখানে তাঁরা ‘সম্পদের মালিকানা’ ধারনাটিকে ভুল মনে করছে বলেই কাজটি করতে পারছে। ফলে, কাঠ সংগ্রহের কাজটি নৈতিকভাবে সঠিক। সঠিক মহাজাগতিক নিয়মের অর্থেও। মার্ক্স এখানে বেশ কাব্যিক। তিনি লিখেন, ধরিত্রীমাতা নিজেই তাঁর সন্তানদের শুকনো কাঠ দিচ্ছেন, এবং বিত্তবানেরা ‘মালিকানা আইন’ বানিয়ে এই মহাজাগতিক প্রাকৃতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। ফলে, কাউকে না বলে কাঠ কুড়নো ন্যায্য এবং প্রাকৃতিক আইনের পথে।
মার্ক্স আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলেন, কেবল দরিদ্র শ্রেণীর চেতনাই কলুষিত হয়নি, সম্পত্তির লোভে। কারণ এরা নাগরিক সমাজের (আমলা-জমিদার-ব্যবসায়ীদের) মত চিন্তা করেনা। এদের চিন্তা ভাবনা প্রকৃতির আইনের সাথে সঙ্গতিপুর্ন।
হেগেল যখন দরিদ্রদের দেখেন তুচ্ছ ও মর্যাদাহীন, সম্পদ নেই, আইনি অধিকার নেই, ধূলিকণার মত। বিপরীতে মার্ক্স জানতে চান, ‘দরিদ্রদের কি আছে?’ মার্ক্স দেখেন, দরিদ্রদের জীবন আছে, স্বাধীনতা আছে, মানবতা আছে, রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আছে, নিজেরাই নিজেদের জন্য আছে। এদের অধিকার আছে প্রকৃতির সকল সম্পদের উপর। পরবর্তীতে আমরা মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উদৃতি পাই, সর্বহারা শ্রেণীর হারানোর কিছু নাই, জয় করবার জন্য আছে গোটা পৃথিবী।
মার্ক্স বলেন, বিত্তবান শ্রেণী আছে তাঁদের “ব্যক্তি মালিকানা” রক্ষায়, অন্যদিক শ্রমজীবী মানুষ আছে, জীবন, স্বাধীনতা ও মানবতা রক্ষার চেষ্টায়। মার্ক্স হেগেলের তাচ্ছিল্য থেকে শ্রমজীবী শ্রেণীকে কেবল রক্ষাই করেন না, উপরন্তু শ্রমজীবী শ্রেণীকেই ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে চিত্রিত করেন। মানুষ হিসেবে মর্যাদাবান করেন, ইতিহাসের প্রগতিশীল শ্রেণী হিসেবে।
দরিদ্র মানুষকে মর্যাদাপুর্ন ভাবতে পারা, সন্দেহ নেই শ্রেণীপক্ষপাতিত্ব, কিন্তু একইসাথে এই ভাবনা সমগ্র মানবতা নিয়ে, সকল মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি একজন সাম্যবাদীর। ১৮৪৮ সালে, ৫ বছর পর মার্ক্স কমিউনিস্ট ইস্তেহার লিখেন।
(লেখাটির জন্য Erica Sherover এর প্রতি কৃতজ্ঞ।)
লেখক: প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
Exit mobile version