চীনকে ঘিরতে যুক্তরাষ্ট্রের যত আয়োজন

মামুন ফরাজী:সাম্রাজ্যবাদীদের স্ব-ঘোষিত বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরো দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের নেশায় মত্ত। তাই অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পরাশক্তি হয়ে ওঠা চীনকে ঘিরে ফেলতে বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশটির প্রধান সঙ্গী হয়েছে ভারত। এ ব্যাপারে এই দু’টি দেশের মধ্যে অতিসম্প্রতি একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশকেও এই মিশনে টানার চেষ্টা চলছে। এজন্য বাংলাদেশকে ‘টোপও’ দেয়া হয়েছে। এদিকে চীন থেকে মিয়ানমারকে দূরে সরানোর চেষ্টাও চলছে। এরই মধ্যে দলে ভেড়ানোহয়েছে অষ্ট্রেলিয়াকে। আর পুরানো বন্ধু জাপানতো আছেই। এছাড়াও চীনের ‘বেল্ড অ্যান্ড রোডের’ পাল্টা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্বার্থ হুমকির মুখে পড়াতেই মূলত: নতুন এই খেলা। চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে, তা বোঝা যায় দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চলাকালে প্রতিরক্ষা মার্ক এসপার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাইক পম্পেও’র ভারত সফর।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তি সই : চলতি বছরের শুরু দিকে লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে সংঘাত ভারতকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এ সময়টিতে চীনের কাছে দারুনভাবে নাজেহাল হয় ভারত।  নিহত হন দেশটির বেশ কিছু সেনা সদস্য। সীমান্তে এখনো উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের খুব কাছে নিয়ে গেছে। কমন শত্রæ চীনকে ঠেকাতে কোন রাখ-ঢাক না রেখেই এক হয়েছে দুই দেশ। এরই অংশ হিসেবে ২৯ আক্টোবর তাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে প্রতিরক্ষা চুক্তি। ওই চুক্তির নাম ‘দ্য বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কো-অপারেশন এগ্রিমেন্ট(বিইসিএ)’। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত খুবই ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করে থাকে। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে দিল্লিতে দুই দেশের মধ্যে ‘ টু প্লাস টু’ ডায়লগ হয়।
চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ নিজেদের মধ্যে ভূ-উপগ্রহের সংবেদনশীল তথ্য (ডেটা) বিনিময় করতে পারেব। ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন বা অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হেনে সেগুলো ধ্বংস করতে ভূ-উপগ্রহের ওইসব তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
‘টু প্লাস টু ডায়লগে’ অংশ নিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার ২৬ অক্টোবর দিল্লিতে পৌঁছেন। ওয়াশিংটন থেকে দিল্লি উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার আগেই মাইক পম্পেও টুইট করে জানান, এই সংলাপের লক্ষ্য হলো একটি ‘ মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল তৈরি করা।’ এই টুইট থেকেই স্পষ্ট চীনকে ঠেকানোই তাদের লক্ষ্য।
ভারতের স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিস্ট সি রাজমোহন বিশ^াস মনে করেন, চীনের চমকপ্রদ উত্থান ভূ-রাজনীতির সমীকরণ বদলে দিয়েছে বলেই মার্কিন প্রশাসন এখন ভারতের সঙ্গে নানা ধরণের সামরিক ও রণকৌশলগত সমঝোতা করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশের কাছে ধর্ণা : ভারতের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধার পর এখন এই অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে কাছে টানতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু কাছে টানা নয়, বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর খেলার অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। চীনের প্রভাব খর্ব করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত দুই দেশই বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।  গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে শক্তিশালী করতে আগ্রহী। ভারতও বাংলাদেশকে সামরিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়ে আসছে। তবে বিশে^র অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন যেভাবে বাংলাদেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক কর্মকাÐে ওতপ্রতোভাবে যুক্ত আছে তাতে বাংলাদেশের পক্ষে চীনবিরোধী জোটে যুক্ত হওয়া অসম্ভব। এখানেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল। তারপরও বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। কেননা বাংলাদেশি  তৈরি পোশাকের বিশাল বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। রেমিটেন্সর একটি বিশাল অংশ আসে দেশটি থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। চীনের দিক দিয়ে এটা উল্টো। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল। আসছে না রেমিটেন্সও। এই বিষয়টিই বারগেইনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধাজন স্থানে রেখেছে। অর্থাৎ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে আছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই খেলায় জড়াতে চাইছে না বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারসাম্যের নীতি নিয়ে এগুচ্ছে এবং বাংলাদেশের জন্য এটাই উত্তম পথ। কোনভাবেই বংলাদেশের অন্যদের খেলার খেলোয়ার হওয়া উচিত হবে না। এতে বাংলাদেশ দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হারাবে জোট নিরপেক্ষ চরিত্র।
মিয়ানমারকেও টানা হচ্ছে : এদিকে মিয়ানমারকে চীনের বলয় থেকে বের করে আনার চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তৎপরতা না দেখালেও তৎপর ভারত। মিয়ানমারকে সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতাও দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। সম্প্রতি ভারত প্রায় ৩৬ বছরের পুরানো সোভিয়েত নির্মিত সাবমেরিন সংস্কার করে মিয়ানমারের নৌবাহিনীকে দিয়েছে। শুধু সাবমেরিন’ই নয়, রাশিয়ার তৈরি টি-৭২ ট্যাংকসহ অন্যান্য সামরিক সরাঞ্জমও মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। তবে মিয়ানমারকে চীনের বলয় থেকে সরিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক মনোভাবাপন্ন করা যাবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
সঙ্গী হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াও : ইন্দো-প্যাসিফিক বা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব মেনে নিতে চাইছেনা অস্ট্রোলিয়াও। কারণ চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেশটির স্বার্থকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। তাই চীনকে লক্ষ্য করে এযাবৎ কালের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী এবং আক্রমণাত্মক এক প্রতিরক্ষা কৌশল বাস্তবায়ন করতে চলেছে অস্ট্রেলিয়া। এই কৌশলের আওতায় দেশটি সৈন্য সংখ্যা বাড়াবে। শত্রæর যুদ্ধ জাহাজে আঘাত করতে সক্ষম দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কিনবে। সাইবার যুদ্ধর ক্ষমতা বাড়াবে। আর এক্ষেত্রে সাহায্যে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল প্রশ্নে দুই দেশের স্বার্থই এক।  ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ‘কোয়াড’ জোটে নিবিরভাবে সমৃক্ত হয়েছে; যে জোটটি এক দশক আগে গড়ে উঠেছে। এর সদস্য দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই জোটের নৌমহড়া হয়ে আসছে। এতে জাপান-ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অংশ নিলেও অস্ট্রেলিয়া ছিলনা। ভারতের আপত্তিতেই মূলত অস্ট্রেলিয়া নৌমহড়ায় যোগ দেয়ার সুযোগ পায়নি। চীন অখুশি হবে বলেই ভারত অষ্ট্রেলিয়ার ব্যাপারে অনীহা জানিয়ে এসেছিল। কিন্তু চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ সেই পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। ভারতীয় একাধিক পত্রিকায় লেখা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপারে ভারত এবার আপত্তি তুলে নিয়েছে এবং কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত নৌমহড়ায় অষ্ট্রেলিয়া যোগ দিয়েছে।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট জন মরিসন বলেছেন, অস্ট্রেলিয়া চায় ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থাৎ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থাকবে মুক্ত। যেখানে কোনো একটি দেশের আধিপত্য এবং জবরদস্তি চলবে না।
পাল্টা বেল্ড অ্যান্ড রোড :চীনের ‘বেল্ড অ্যান্ড রোডের’ পাল্টা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। গত ফেব্রæয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ান ফাইন্যান্সিয়াল রিভিউয়ের এক প্রতিবেদনে এ খবর প্রকাশিত হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, এই চার দেশ মনে করছে চীনের বেল্ড অ্যান্ড রোড কর্মসূচিতে যত বেশি দেশ সামিল হবে, চীনের প্রভাব তত বাড়বে। এজন্য পাল্টা ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে দেশগুলো।
শেষ কথা : যুক্তরাষ্ট্র একটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা মাথায় রেখে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ নানা দেশের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি করতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর গত তিরিশ বছর ধরে সেই জায়গাটায় একটা তুলনামূলক স্থিরতা ছিল। কিন্তু এখন চীন সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠায় পুরো প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। তাই এই অঞ্চলের নিরপত্তা ইস্যুগুলো কীভাবে অ্যাড্রেস করা হবে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। শুধু ভাবা নয়, কাজও শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু চীন কী বসে বসে যুক্তরাষ্ট্রের এই খেলা দেখবে?মোটেই না। দেশটি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ট করে চলেছে। এক্ষেত্রে ইরান অন্যতম। ইরানের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো মিত্র পাকিস্তানও এখন চীনের ঘনিষ্ট মিত্র। নানা কারণে তুরস্কও চীনের দিকে ঝুঁকছে। ভারত সাগরের দেশ শ্রীলংকায়ও চীনের প্রভাব ব্যাপক। নানা কারণে বাংলাদেশেও চীনের প্রভাব বিদ্যমান। সবমিলে নতুন এই খেলায় যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হবে কি-না তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।