শুক্রবার,২৯,মার্চ,২০২৪
24 C
Dhaka
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
Homeজীবন সংগ্রামতিস্তার দু:খ : তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা

তিস্তার দু:খ : তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা

গেল বছর তিস্তার ভাঙন শুরু হয়েছিল আগস্ট মাসে।এবার শুরু হয়েছে আগাম।ভরা বর্ষায় পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ- এনিয়ে তিস্তার দুই তীরের মানুষের শঙ্কা,উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে।এবার মে-জুন মাসেই আগাম ভাঙনের কবলে তিস্তাপারের সমৃদ্ধ গ্রাম। তিস্তার দুই তীরের ভাঙন পীড়িত মানুষের কান্না আর আহাজারিতে ক্রমশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠছে।সরেজমিনে দেখা গেছে,গত ৭ দিনে প্রবল ভাঙনে লালমনির হাট উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের কুটিপাড়া,বানপাড়া,বাদিয়াটারি,চৌরাহা, কুড়িগ্রাম- উলিপুর উপজেলার চর বজরা, হেকোডাঙা,নাগরাকুড়া ,রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ,রংপুরের পীরগাছা উপজেলার শিবদেব,নামা রহমতচর এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাশিম বাজার ও চর খোর্দা গ্রামের অসংখ্য পরিবারের বসতভিটা,ঘরদোর,আবাদিজমি,পাকারাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্হাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।হঠাৎ বন্যার পানিতে চরাঞ্চলের সবজি,বাতাম ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।এলাকাবাসীর দাবি,”আমরা রিলিফ চাইনা,চাই বন্যা ও ভাঙনের স্হায়ী সমাধান। চাই তিস্তা নদী সুরক্ষা,চাই চরাঞ্চলের কৃষির জন্য বিশেষ প্রণোদনা,ক্যাস সাপোর্ট।চাই এনজিও দাদন ব্যবসায়ীদের সুদ- আসল সব মওকুফ।চাই দাদন ব্যবসায়ীদের নিপীড়ন ও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে।চাই কাজ,স্বাস্থ্যসুরক্ষা,করোনার টিকা এবং রেশন।চাই কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য”।
নিজস্ব উদ্যোগে গণচাঁদা সংগ্রহ করে বাঁশ,বালু দিয়ে শত চেষ্টা করেও মানুষ থামাতে পারছেনা তিস্তার ভাঙন।বাঁশ প্রযুক্তিও কাজে লাগছে না।লাগবে কিভাবে! তিস্তার কি গভীরতা আছে?খরাকালে তিস্তার বুক বালুতে উঁচু হয়ে থাকে।বিস্তৃন চরাঞ্চলের কৃষিজমি হয়েছে নিচু-ঢালু।চরাঞ্চলের ঢালু জমিতে তৈরি হয়েছে বালু মহাল।তিস্তার ঢালু জমি থেকে এক্সক্যাভেটর, লোকাল ড্রেজারে বালু ও পাথর উত্তোলনের মহোৎসব চলছে জোরেসোরে।এদের অবৈধ অপকর্মে তিস্তার দুই তীরের পানি উন্নয়ন বোর্ড়ের বাঁধও পড়েছে ভাঙনের মুখে। এই দানবিক শক্তিকে ঠেকানোর ক্ষমতা চরাঞ্চলের মানুষের নেই।শোষকশ্রেণীর সব দল ও জোট একাজে এক।অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি নানাজাতের কোম্পানি তিস্তার তীর দখল করে, তীর ঘেঁষে নানা স্হাপনা,পর্যটন ও ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে।এরা তিস্তার তীর, বুক, তিস্তার শাখা-প্রশাখা নদ-নদীর পানি চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে বাঁধ,পাকারাস্তা নির্মাণ করছে যত্রতত্র।তিস্তার শাখা-প্রশাখা নদীও দখল হয়েছে,হচ্ছে।তিস্তার শাখা-প্রশাখা ও উপশাখাগুলোর সঙ্গে তিস্তা নদীর সংযোগ স্হাপন এবং দখলমুক্ত করা ছাড়া বাঁচার অন্য কোন পথ নেই।বর্ষাকালে উজানের ঢলের পানি দ্রুত ব্রম্মপুত্র-যমুনা দিয়ে সাগরে নামতে পারছেনা। তিস্তার শাখা- প্রশাখার পানি চলাচলের প্রবাহমূখ বন্ধ।পানি ছড়িয়ে পড়ে তিস্তার কিনারের গ্রামে।ফলে বর্ষাকালে প্রায় পাঁচমাস তিস্তা অববাহিকার ক্ষেতখামার-ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে থাকে।তিস্তাপারের মানুষের জীবনে এসময় নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও দুর্গতি। নানা পথ দিয়ে পানি চলাচল করবে এটাই পানির ধর্ম।চলাচল শেষে পানি তার গন্তব্য- সাগরে নামবে এটাও সত্য! তিস্তার মূল খাত উঁচু ও ভরাট থাকায়,তিস্তার শাখা- প্রশাখা নদী দখল ও প্রবাহের পথ বন্ধ থাকায় বর্ষাকালে শুধু তিস্তা অববাহিকায় নয়,রংপুর বিভাগের নিম্নাঞ্চল এবং শহরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। গেল কয়েক বছর নীলফামারী,লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম,দিনাজপুর,,গাইবান্ধাসহ বিভাগের প্রায় প্রতিটি শহর হাটু ও বুক পানিতে ঢুবে গিয়েছিল।শহরের মানুষের ঘরেও জমেছিল হাটুপানি। বিভাগীয় শহর রংপুরের বুকদিয়ে ৫টি নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বিদ্যমান।এই প্রবাহের মূল নদ ঘাগট।তিস্তার শাখা ঘাগটের মুখ বন্ধ থাকায় রংপুর শহরের পানি দ্রুত নামতে পারছেনা।এরকম দশা দেশের সব শহরেই।অন্যদিকে বন্যার পর গোটা তিস্তা অববাহিকা জুড়ে শুরু হয় নদী ভাঙনের তান্ডব।এই প্রক্রিয়া চলছে রংপুর বিভাগ, উত্তরাঞ্চলসহ গোটা দেশেই।তাই,জলবায়ু পরিবর্তনের অশুভ অভিঘাত থেকে বাঁচতে গোটা দেশেই নদী রক্ষার সংগ্রাম জোরদার করা জরুরি।জরুরি অতিলোভী মুনাফাখোর লুটেরা নদী খেকো অপশক্তির হাত থেকে নদী দখলমুক্ত করার সংগ্রামকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।এই অপশক্তিকে দমাতে নাপারলে রাজধানীসহ গোটা বাংলাদেশের মানুষ,গোটা দেশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম সবচেয়ে ” বড়” শ্রেণি সংগ্রাম।বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহার করায় ভাটির বাংলাদেশের বিপদ ক্রমাগত বাড়ছে।উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বরফ গলে সাগরে পড়ছে।সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে।করোনার অতিমারির সঙ্গে বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়,জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ও বন্যার ভয়াবহ প্রকোপ।বাড়ছে অসহনীয় জলজট।সাগরের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ টি উপকুলীয় জেলায়।উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়ছে।ক্রমাগত মিঠাপানির সংকট বাড়ছে।জাতিসংঘ বলেছে,২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে।এর বাইরেও আছে শঙ্কাজনক খারাপ দিক।বাংলাদেশের একার পক্ষে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।এই সমস্যাকে বৈশ্বিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।প্রকৃতি,পরিবেশ-প্রতিবেশ সর্বোপরি “পৃথিবীকে” রক্ষার সংগ্রামটাকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে রূপান্তরিত করতে হবে।আমাদের হাতপা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবেনা।আমাদের নিজেদের অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিজ দেশীয় চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি।এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য খুবই প্রয়োজন।এই ঐক্যে সমস্ত রাজনৈতিক দল,সামাজিক-সাংস্কৃতিক- পরিবেশবাদী সংগঠন,বিভিন্ন পেশাজীবী, সামরিক এবং বেসামরিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে অগ্রধিকার ভিত্তিতে বর্তমান সরকার ও সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী “তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ হাতে নিয়েছেন।এ প্রকল্প কোন বিদেশী প্রকল্প নয়,এটা জলবায়ু অভিযোজন প্রক্রিয়ার অংশের আমাদের নিজস্ব প্রকল্প অগ্রাধিকার দিয়ে ” তিস্তা মহাপরিকল্পনার” ডিজাইন করা হয়েছে।এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এর আদলে গোটা দেশের নদী সুরক্ষার কাজ হবে- এটাই আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি।অগ্রাধিকার বিষয়টি এসেছে তিস্তাকে ঘিরেই।আঞ্চলিক বৈষম্যের কারণে।এখনো গোটাদেশে দশটি জেলার মধ্যে রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলায় দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি, ৪৬ শতাংশ।কুড়িগ্রামে এই হার এখনো ৭১%।রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের জন্য আমাদের বরাদ্দ তলানিতে,গড়. ০৯৮ টাকা।করোনার অতিমারিতে চলমান দারিদ্র্যের হার আরো বেড়েছে।দারিদ্র্য বৃদ্ধির অন্যান্য অনেক কারণের মধ্যে নদীর ভাঙন অন্যতম।সবমিলে প্রতি বছর ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে নদী ভাঙনে।চীনের হেয়াংহোর মতো ” তিস্তার দু:খ” এখানেই। তিস্তার তলা গভীর করে খনন,দুই তীরের শক্ত বাঁধন ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।একমাত্র বিকল্প তিস্তানদী পুনরুদ্ধার – শীর্ষক “তিস্তা মহাপরিকল্পনার” দ্রুত বাস্তবায়ন।টোটকাটুটকি ওষুধপাতি দিয়ে পাগলা তিস্তাকে থামানো যাবেনা।তিস্তার ভাঙনকে যাদু ঘরে পাঠাতে হলে প্রয়োজন, “তিস্তা মহাপরিকল্পনার” কাজ শুরু করা।সরকারের শীর্ষ কর্তারা ঘোষণা করে বলেছেন, সমীক্ষা শেষ।সব চূড়ান্ত।এই আর্থিক বছরেই কাজ শুরু হবে।আমরা আর চাতক পাখির মতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে রাজি নই।প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী সুচারুভাবে কাজ হলে তিস্তার মূল চ্যানেলের গভীরতা বাড়বে।দুই তীরের বাঁধন হবে শক্ত।
পদ্মা সেতুর চারপাশের নদী শাসনের আদলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তিস্তাকে শাসন করা হলে ভাঙন ঠেকবে।রক্ষা পাবে তিস্তাতীরের নীলফামারী, লালমনিরহাট,রংপুর,কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার ভাঙন কবলিত জনপদ।থামবে ভাঙনপীড়িত মানুষের কান্না।বাঁচবে ” হিডেন ডায়মন্ড খ্যাত” তিস্তা চরের কৃষি ও কৃষক।শিক্ষার ধারা সচল থাকবে চরাঞ্চলের মানুষের সন্তানদের।দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভান্ডার থাকবে অটুট।তিস্তা মহাপরিকল্পা ঘিরে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্ম সংস্থানের সুযোগ। অনেকাংশ লাঘব হবে আঞ্চলিক বৈষম্য।কিছুটা হলেও নিশ্চিত হবে মানুষে মানুষে,অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য নিরোধের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। বঙ্গবন্ধু আজীবন ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।পাশাপাশি খরাকালে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতেও আমাদের সজাগ থাকতে হবে।তিস্তা শাসন “তিস্তা চুক্তির” বিকল্প নয়।পরিপূরক।দেশীয় ব্যবস্থাপনায়, আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক কারিগরি সহযোগিতায়( পদ্মা সেতুর মতো)তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।তিস্তা সুরক্ষার কাজটিকে কোন অজুহাতেই ঝুলিয়ে রাখা যাবেনা।তিস্তা নদী সুরক্ষায় ” ৬ দফা” দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।তিস্তা নদী তীরবর্তী গ্রামে গ্রামে গঠিত হচ্ছে ” তিস্তা বাচাও,নদী বাচাও” সংগ্রাম কমিটি।তিস্তাপারের তরুণরা নিজেরাই এলাকায় এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গড়ার কাজে উদ্যোগী ভূমিকা রাখছে।করোনা প্রতিরোধেও তারা নিজ নিজ এলাকায় স্বাস্থ্য সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে মানুষের ঘরেঘরে।গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তিস্তার দুইতীরের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী’রা।তিস্তাতীরের ভাঙনপীড়িত মানুষ বুকভরা আশা নিয়ে বসে আছে কবে চীনের হোয়াংহ নদীর মতো “তিস্তার” দু:খ মোচন হবে- সেই আশায়।
লেখক: সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক,নজরুল ইসলাম হক্কানী,শফিয়ার রহমান,তিস্তা বাঁচাও,নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ।

সর্বশেষ