মঙ্গলবার,১৬,এপ্রিল,২০২৪
38 C
Dhaka
মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়নারীর মানবাধিকার অর্জনে বেগম রোকেয়া

নারীর মানবাধিকার অর্জনে বেগম রোকেয়া

॥ এ্যাড. জোবায়দা পারভিন ॥

মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া একাধারে সমাজ সংস্কারক মানবাধিকারের প্রবর্তক, নারীমুক্তি ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একজন সাহসী যোদ্ধা। বিংশ শতকের শুরুতে যারা প্রতিক্রিয়াশীলতার দূর্গে একের পর এক আঘাত হেনেছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বেগম রোকেয়া। ১৮৮০ সনের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের একে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। তখন ছিল অবরোধ প্রথার কঠোর যুগ। যেখানে মেয়েদের লেখাপড়া ছিল নিষিদ্ধ। শৈশব ও কৈশরে শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত একজন কন্যা।
নিজের প্রচেষ্টায় ভাই-বোনের সহযোগিতায় নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তোলেন বড়বোন করিমুন্নেছার কাছে মানুষ হওয়ায় বড় ভাই ইব্রাহীমের কাছে গোপনে শিখেন বাংলা-ইংরেজি। ১৮৯৮ সালে বিয়ে হয় সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। জাগরণের অগ্রদূত হিসাবে বিকাশ ঘটে স্বামীর উৎসাহেই। ১৯০৯ সনে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। বেগম রোকেয়া অধিকার বঞ্চিত নারী সমাজের শিক্ষার জন্য ভাগলপুরে গড়ে তোলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালস স্কুল। মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে। তিনি বাড়ী বাড়ি ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষা ছাড়া নারীর অগ্রগতি সম্ভব নয়। নিরন্তর লড়াই করেছেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নারী ও পুরুষের যে বিপরীত ভাবমূর্তি পুরুষতন্ত্র সৃষ্টি করেছে তিনি তা ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেছেন। সেচ্চার ছিলেন ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের হাতিয়ার’-ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে। ১৯০৪ সনে তার প্রথম লেখা ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ তে তিনি লেখেন “প্রবল সব বাধা অগ্রাহ্য করিয়া যখনই কোনো ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপে অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চুর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত; যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।” একটি পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের সদস্য হয়ে সেকালে বেগম রোকেয়া কি করে এমন চৈতন্যকে ধারণ করছিলেন ; তার কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মানদ- মানসিক শক্তি। তিনি নারীর মানসিক দাসত্বের কথা কলেছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের একটা রোগ আছে দাসত্ব। আমাদের মন পর্যন্ত দাস হইয়া গিয়াছে। শরীর যেমন জড়পি-, মন ততোধিক জড়।” তিনি আরো বলেছেন, “আমাদের শয়ন কক্ষে যেমন সূর্যের আলো প্রবেশ করে না, তদ্রুপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলো প্রবেশ করতে পারে না। বহুকাল হইতে নারী হৃদয়ের উচ্চ বৃত্তিগুলি অংঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর বাহির, মস্তিষ্ক হৃদয় সবই দাসী হইয়া পড়িয়াছে।” তিনি মানসিক শক্তি অর্জনের জন্য সুশিক্ষার প্রতি বিষশষ জোর দিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি বলেছেন, “পুরুষের সমকক্ষমতা লাভের জন্য আমাদের যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয় তবে তাহাই করিব। উপার্জন করিব না কেন ? আমাদের কি হাত নাই, পা নাই, নাকি বুদ্বি নাই। কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও। নিজের অন্নবস্ত্র উপাজন করুক।”
তিনি নারীদের সংগঠনও গড়ে তোলেন। ১৯১৬ সালে আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি নারী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। নারীর অবরোধ থেকে মুক্ত করতে নারীশিক্ষা প্রসারে এই সংগঠন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয় ও লিঙ্গ সমতার যুক্তি তুলে ধরেন। পুরুষতান্ত্রিকতায় সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তোলেন। ‘মতিচুর’ গ্রন্থে বলেছেন, “আমাদের অস্থান আমরা চিন্তা না করিলে আর কেহ আমাদের জন্য ভাবিবে না। অতএব জাগো জাগো ভগিনী। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি মেজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিষ্টার, লেডি জজ সবই হইব।”
তিনি সমাজের অগ্রযাত্রায় নারীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন, “আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে ? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে ? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্যেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।”
আজকে সমাজের সর্বস্তরে নারীর যে পদচারণা তা এই মহিয়সী নারীর অবদান। কিন্তু বেগম রোকোয়ার চেতনায় যে গতিশীলতা ছিল সেইভাবে কি নারী মুক্ত হয়েছে? নারীর অগ্রগতি হয়েছে? আমাদের সংবিধানে নারীর সম-অধিকারের কথা বলা হয়েছে। নারীর সমতা আনায়নের জন্য নারীর পক্ষে বহু আইন বিধি ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আজো নারী নির্যাতন ধর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সনদ ও আমাদের সংবিধানের আলোকে ১৯৯৭ সালে, ২০০৪ সালে এবং ২০০৮ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রকাশ করা হয়। বর্তমান সরকার নারীর অসমঅবস্থান দূর করার উদ্যেশ্যে আরো সমৃদ্ধ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রনয়ন করে। যার মধ্যে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অতীত এবং বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। কিন্তু সমাজের মোল্লাদের বাধার জন্য আজো তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি। সিডো সনদের ২ টি ধারা এখনো গ্রহণ করে নাই। তাই বেগম রোকেয়ার থেকে শিক্ষা ও শক্তি নিয়ে নারীর মানবাধিার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নে আন্তর্জাতিক সনদ, সংবিধান; আইন ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি সমূহ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ লড়াই চলছে, চলবে।

লেখকঃ সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

সর্বশেষ