পাকিস্তানে গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে : সেনাপ্রধান সংবিধান ও বিচারের উর্ধে: বাংলাদেশ পাকিস্তানের সম্পর্কের ভবিষ্যত কি? অর্থনৈতিক সুবিধা নাকি সামরিক সম্প্রসারণ! গণতন্ত্রের জন্য তা কতটুকু শুভ!/?
গত কয়েক দিন ধরে পাকিস্তানের সংসদ বেশ উত্তপ্ত। সামরিক বাহিনীর প্রধান সকল বাহিনীর প্রধান হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং তাঁর কার্যক্রম সংবিধান ও বিচারের উপরে থাকবে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তানের জন্মকে তৎকালীন মুসলিম লীগ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস তাই ভারতের একদিন আগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর তার প্রতিষ্ঠাতা কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু হয়। তারপর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের হাল ধরেছিলেন। তাঁকে সরে যেতে হয়। কালে সংবিধান স্থগিত করে ক্ষমতায় আসেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। মজার বিষয় হলো ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হলেই সেনাবাহিনীর প্রধানের কপাল খুলে যায়। আইয়ুব খান থেকে তা শুরু। তিনি ফিল্ড মার্শাল জেনারেল হয়েছিলেন পাক ভারত যুদ্ধের পর। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। কয়েক মাস আগে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর সেনাবাহিনী প্রধান মুনিরেরও পদোন্নতি হয়। তিনিও জেনারেল হন। এরপর তাঁর আন্তর্জাতিক তৎপরতা বেড়ে যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ নজরে আসেন এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেন।
অতিসাম্প্রতিক ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ থামানোর একক কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন। এরপর হঠাৎ করে শুল্কযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছু টানাপোড়েন শুরু হয়। পাকিস্তান তার সুযোগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আরও কাছাকাছি যায়। পাকিস্তান ইতিমধ্যে সৌদি আরবের সাথে একটা কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করে এবং গাজা সম্মেলনে ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান ট্রাম্পের সাথে সম্পর্কের আরও উন্নয়নের সুযোগ পায় যখন ট্রাম্প আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান বন্দর দাবি করে। কারণ পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পর্ক প্রায় সত্তর বছরের বেশি। তালেবানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বেস ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান তাতে আর্থিক সুবিধা পায়। পাকিস্তানে গড়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি।
সবসময় একটা যুদ্ধাবস্থায় থাকে পাকিস্তানের রাজনীতি। আর তার সুবিধা ভোগ করে সামরিক বাহিনী। ফলে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনীতি তেমন টেকসই হয় না। পাকিস্তানের যা কিছু কির্তী তার সবই সামরিক বাহিনীকে কেন্দ্র করে। ফলে সহজেই সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে এবং বেশির ভাগ প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্য হয়, হয় ফাঁসি, জেল বা দূর্ঘটনায় বা আততায়ীর হাতে মৃত্যু। সর্বশেষ জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সুদৃষ্টি হারিয়ে ছিলেন। ফলে সেনাবাহিনী তাঁকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা অসীম। তারা মরা প্রধানমন্ত্রীকে জিন্দা করতে পারেন আবার জিন্দা প্রধানমন্ত্রীকে ঝুলিয়ে দিতে পারে। সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান আসগর খান বলেছিলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার নিজের দেশ ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় সফল হতে পারেনি। অর্থাৎ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সবসময় নিজ দেশের জনগণকে পদানত করতে পেরেছে। যাইহোক, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সাথে যুদ্ধের পর জেনারেল আসিফ মুনির নতুন করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান যেখানে সংবিধান ও বিচার বিভাগের হাত পৌছুবে না। পাকিস্তানের সংসদ হাততালি দিয়ে তা সমর্থন করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ। অবশ্য, ইমরান খানের দল বিরোধিতা করেছে। তাই, এখন একথা নির্দিধায় বলা চলে, পাকিস্তান একটা সাংবিধানিক সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখন আর গনতন্ত্রের সুপ্রিমিসী থাকবে না।
পাকিস্তানের এই সাংবিধানিক সামরিকতন্ত্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যত কি? বাংলাদেশে আগামী বছর একটা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তার আগে গত এক বছরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, উপ প্রধানমন্ত্রী থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তারা বাংলাদেশে ভ্রমণ করেছেন। পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্রিয়াশীল সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, আইএসআইয়ের কর্মকর্তারও বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশ পাকিস্তান যৌথ বানিজ্য কো-অপারেশনেরও বৈঠক হয়েছে। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ও ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকার পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের খাতগুলো পর্যালোচনা করছে। এতে আর্থিকভাবে তুলাসহ কয়েকটি পণ্যের আমদানিতে সুবিধা ছাড়া তেমন সুবিধা এখনো স্পষ্ট হয়নি।
যেটা প্রণিধানযোগ্য, তাহলো, পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে সামরিক সম্পর্ক দৃঢ় করার দিকে মনোযোগী বেশি, কারণ এখানে রাজনীতির গভীর যোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক তেমন মসৃণ নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধের ফলাফলই বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ফলে এখানে জটিলতা রয়েছে। আর বাংলাদেশকে যদি পাকিস্তান তার সামরিক মিত্র হিসেবে বিকশিত করে তবে পাকিস্তানের সাথে তার প্রতিবেশীদের যুদ্ধ বাংলাদেশের উপরও চাপবে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বোঝা হবে। বাংলাদেশ একটা বিকশিত অর্থনীতির দেশ, যুদ্ধের বোঝা নিতে সে সক্ষম নয়। বাংলাদেশ একটা গণতন্ত্র প্রত্যাশী দেশ; এখানে সামরিক শাসন তেমন কাঙ্ক্ষিত নয়। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক গনতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায়ও সহায়ক হবে কিনা তাও ভাবতে হবে। শেষ বিচারে পাকিস্তানের জনগণ গনতন্ত্রের সুবিধা বঞ্চিত থেকে যায় নানা পালাবদলে। বাংলাদেশ তার বিপরীত। বাংলাদেশ সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি বা শাসন পছন্দ করে। এখন তাই, পাকিস্তানের এই সাংবিধানিক সামরিকীকরণের ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
লেখক- শরীফ শমশির
লেহক ও গবেষক



