মহামতি এংগেলস স্মরণে

ফ্রেডারিক এংগেলস ১৮৯৫ সালের ৫ আগষ্ট মারা যান। মার্ক্স সম্পর্কে এংগেলস এর একটা বিখ্যাত কথা আছে,তিনি মার্ক্স সম্পর্কে বলেছেন, আমাদের বড় জোর বুদ্ধিমান বলা যায়, কিন্তু মার্ক্স ছিলেন জিনিয়াস বা প্রতিভাবান। এর চাইতে বেশি কিছু মার্ক্স সম্পর্কে বলার প্রয়োজন নাই। তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু এবং প্রতিভার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে যিনি এই উক্তি পান, তার সম্পর্কে অন্যদের কোন মূল্যায়নের আর দরকার পরে না। মার্ক্সের পুঁজির পরবর্তী দু’টি খন্ড এংগেলস সম্পাদনা করেন। এটা না করে গেলে অন্যদের হাতে পড়লে কি হতো তা বলা যায় না। মার্ক্সের মত অমিত তেজি সূর্যের আলোতেও এংগেলসএর লেখা কয়েকটি বইএর কথা বললেই বোঝা যাবে, মানব সভ্যতার জন্য এংগেলস কি করেছেন। তাঁর প্রথম বিখ্যাত বই ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা যা ১৮৪০ এর দশকে লেখা, যখন কার্ল মার্ক্স রাজনৈতিক অর্থনীতির জগতে সেই অর্থে প্রবেশ করেননি। আমি মনে করি, এই বইটা পড়ার পরই এংগেলস কে একজন পরিচিত বন্ধুর পর্যায় থেকে সভ্যতার ইতিহাসের সর্বত্তোম বন্ধুতে রূপান্তরিত করেন মার্ক্স।

তারপর ইতিহাস। মার্ক্সের রাজনৈতিক অর্থনীতির জগতে গবেষণার জন্য প্রবেশ এবং এংগেলেসের প্রতিভাবান বন্ধুর পাশে বছরের পর বছর ঢাল হয়ে থাকা। সেটাও ইতিহাস। তারপর আসি তার পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি বইএর কথায়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপর এই সুসংবদ্ধ বইএর মত বই আর নেই। এরপর এন্টিড্যুরিং ও সবশেষে প্রকৃতিতে দ্বন্দবাদ, ডায়ালেক্টিকস অব নেচার। সর্বশেষ বইটি তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি, তিনি পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে গিয়েছিলেন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতাদের কাছে। তারা হয় এই বইএর মূল্য বোঝেননি নতুবা কোন মতলব ছিল তাদের। বইটির পান্ডুলিপি প্রথম রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর। এমনকি লেনিন নিজেও এই পান্ডুলিপিটি দেখেননি, দেখলে তিনি সংগে সংগে তা ছাপার ব্যবস্থা করতেন, এবং ম্যাটেরিয়েলিজম এন্ড এম্পিরিওক্রিটিসিজম বইতে তার উল্লেখ করতেন। এই বইতে প্রকৃতিতে দ্বন্দবাদের উল্লেখ করতে যেয়ে তৎকালিন সময়ে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের যে বিষয়গুলো এংগেলস উল্লেখ করেন, সেগুলো আধুনিক বিজ্ঞানের একেবারে গোরার দিকের আবিষ্কার। তখন আলোর কোয়ান্টাম থিওরি আবিষ্কার হয়নি, হয়নি পরমাণুর প্রকৃত তত্ব। রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, দ্য ব্রগলির কণা তরংগের দ্বৈততা, পার্টকেল ফিজিক্সের ইলেক্ট্রন পজিট্রন এন্টি পার্টিক্যাল তত্ব, হিগস মেকানিজম, ব্ল্যাক হোল এনট্রপি, ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন এ রকম আরো অনেক কিছু তখনো বিজ্ঞানীদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। প্রকৃতির দ্বন্দবাদ ব্যবহার করে আরো কত যুগান্তকারী আবিষ্কার হবে, তার ইয়ত্বা নেই।

এটা আমার বুঝ। আমি ইতিমধ্যেই এংগেলস এর চিন্তাকে ভিত্তি করে এখনো অমিমাংসিত একটি বিষয়ের বৈজ্ঞানিক সমাধান প্রস্তাব করেছি, যা কোন জার্নালে হয়তো প্রকাশিত হতে পারে। এংগেলস এর এই দার্শনিক চিন্তা বিজ্ঞানের অনেক অমিমাংসিত বিষয়ের মিমাংসা করবে বলে আমার ধারণা। আজ এই অমিত প্রতিভাবান মানুষটির মৃত্যু দিনে আমি তা দৃঢ়ভাবে বলছি। বহু বছর হয়ত মানব সভ্যতা তাকে স্মরণ করবে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের জন্য দৃষ্টিভংগীর সংকীর্ণতার জন্য পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা অনেকে তাঁকে চেনেন না। উল্টো দিকে যারা তাঁর মতাদর্শের লোক বলে দাবী করেন, তারাও তার অবিস্মরণীয় চিন্তাকে খুব কম মূল্য দিয়েছে। আমি আমার জীবনের প্রায় ৫০ বছর তাঁর প্রকৃতিতে দ্বন্দবাদ বোঝার চেষ্টা করেছি। যারা বিজ্ঞানের ছাত্র এবং কাটিং এজ প্রব্লেম নিয়ে গবেষণা করে তাদের জন্য এই বইটি অবশ্য পাঠ্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছ থেকে জানলাম চীনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত আছে। আমেরিকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরমালি নাই, ইনফরমালি নিশ্চয় আছে। যাহোক, আজ এই বিপ্লবীর মৃত্যুদিবস। তিনি বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, দার্শনিক সকল ক্ষেত্রেই একজন বিপ্লবী, তাই তাকে জানাই বিপ্লবী শ্রদ্ধা। বিপ্লব মানেই বর্তমান সংকট ও ব্যবস্থাকে পালটে নতুন এবং অগ্রসরমান ব্যবস্থায় পালটে যাওয়া। কোন কিছু পাল্টালেই তা বিপ্লব নয়, তা প্রতিবিপ্লবও হতে পারে। এংগেলস এর একটি কথা দিয়েই শেষ করি, তিনি তার এক ইউরোপীয় বন্ধুকে লিখেছিলেন, শ্রেনিবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের পক্ষে কাজ করলে, সমাজ দ্রুত এগিয়ে যায়, বিপক্ষে কাজ করলে উৎপাদন সম্পর্কের গতি থেমে যায়, স্থবির হয়, অনেকক্ষেত্রে তা পিছনের দিকে যায়, যাকে ইতিহাসের পশ্চাৎপসরন মনে হয়। কিন্তু, সেটা স্থায়ী নয়, শেষমেশ ইতিহাসের গতি সামনের দিকে। এটাও তার প্রকৃতির দ্বন্দবাদের মতো। মানুষ কোন কোন সময় এই স্থবিরতা বা পশ্চাদপসরণ দেখলে হতাশ হয়। কিন্তু, দার্শনিক সত্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে, মানুষ স্থিতধী হয়। জয়তু বিপ্লবী মহামতি এংগেলস।