Site icon নতুন কথা

বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান!

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গ্রহণ করেছিল।এনিয়ে অনেক জ্ঞানপাপী আমাদের তিরস্কার করে বলেছিলেন,১৯৭২ সালে প্রাণিত সংবিধান ভারতের সংবিধানের কার্বনকপি। একদম মিথ্যাচার!ভারতের সংবিধানে সেক্যুলারিজমের সংযুক্তি ঘটে ১৯৭৬ সালে।চারটিখানি কথা নয়। এছিল রক্তে কেনা ঐতিহাসিক লিখিত দলিল।বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল একসাগর রক্তের বিনিময়ে।তাই, ১৯৭২ সালে ধর্মনিরপেক্ষতা,গণতন্ত্র,বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র – এই চার মূলনীতি প্রজাতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে শক্তপোক্তভাবে অনুমোদিত ও গৃহিত হয়।১২ অক্টোবর ১৯৭২ গণপরিষদে বাঙালি জাতীর স্হপতি,জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের মূলনীতি কেন? তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলেন: ” ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।তাতে বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষের ধর্ম- কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না।মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে।তাদের বাঁধা দিবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই।হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে,কারো বাধা দিবার ক্ষমতা নেই।বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে,খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে।তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না।আমাদের শুধু আপত্তি হলো,ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি,ধর্মের নামে বেঈমানি,ধর্মের নামে অত্যাচার,খুন,ব্যাভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে।ধর্ম অতি পবিত্র জিনিষ।পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।যদি কেউ বলে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে— আমি বলব,ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি।সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।” বঙ্গবন্ধুর সেই কালজয়ী চিন্তা এখনো যে কতটা প্রাসঙ্গিক তার প্রমাণ মিলছে সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে।বঙ্গবন্ধুর চেতনার সাথে আপোষ করার পরিনাম কী ভয়াবহ রূপ নিতে পারে তাও আজ স্পষ্ট।এখন বিশ্লেষণ করব ১৯৭২-এর সংবিধানে গৃহীতধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ধারণা পশ্চিমের চিন্তাধারা থেকে বহুলাংশে আলাদা।বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতারকথা বলা হয়নি।এখানে রাষ্ট্র থাকবে নিরপেক্ষ।প্রত্যেক ধর্ম বিশ্বাসী ব্যক্তি – সম্প্রদায় তাদের নিজনিজ ধর্ম নির্বিগ্নে পালন করতে পারবেন।এক্ষেত্রে রাষ্ট্র শতভাগ সব ধর্মের মানুষের ধর্ম চর্চায় কোন বাধা সৃষ্টি করবে না।এক কথায়, ” ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার”।পশ্চিমের অনেক দেশেই ধর্মচর্চার বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত।যা বাংলাদেশে একেবারেই নিষিদ্ধ।বাংলাদেশে কেউ কোন ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করলে তার শাস্তি অবধারিত।৭২-এর সংবিধানে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ৭১ এ যারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ,ধর্ষণসহ নানা ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত ছিল তাদের রাজনীতি করার ও দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।কিন্তু প্রত্যেক মানুষের ধর্মচর্চার অধিকার বাহাত্তরের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত ছিল।বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী যারা ‘৭২-এর সংবিধান তৈরি করেছেন তারা ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করার কথা বললেও ব্যক্তি জীবনে তারা সবাই ছিলেন নিজনিজ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ।৭১ এ যার জন্ম হয়নি এমন এক তরুণ নেতার মুখে নতুন বয়ান শুনেছি।তিনি বলেছেন, আওয়ামীলীগের মধ্যে কোন মুসলমান নাই’।এ কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই নেতা যাদের পক্ষাবলম্বন করে বয়ান দিয়েছিলেন তাদের ভ্রষ্টাচারের নানা কাহিনী এখন তো সর্বজনবিদিত।বাংলার জমিনে হাজার বছরে লালিত শ্বাশত ইসলামি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে ওই ভ্রাষ্টাচার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না,হতে পারে না।সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ কোন আলেম সমাজ এটা মানবেন না।’৭২- এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহনের পর অতি ডান এবং অতি বামপন্থি শক্তির পক্ষ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে আক্রমন করা হয়েছিল।অতি ডানপন্থীরা বলা শুরু করলেন, ‘ ধর্মনিরপক্ষতার অর্থ হচ্ছে নাস্তিকতা,রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে বাংলাদেশে কোন মসজিদ থাকবে না।আযান নিষিদ্ধ হবে।ধর্ম পালন ও প্রচারের স্বাধীনতা থাকবে না।এসময় অনেকেই পালিয়ে সৌদি আরবসহ নানা মুসলিম দেশে অপপ্রচারে মেতে উঠছিলেন।বলেছিলেন,ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে সব মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে।আজান শুনা যাচ্ছে না।বাংলাদেশে সবাই নাকী ওলু ধ্বনি দিচ্ছেন।অপরদিকে অতি বামপন্থি একটি ক্ষুদ্র শক্তি বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজম সম্পর্কিত ধারণাকে গোঁজামিল হিসেবে মূল্যায়ন করেছিলেন।তারা বলেছিলেন, “সেক্যুলারিজমের অর্থ হচ্ছে ইহজাগতিকতা,রাষ্ট্র ও সমাজের কোথাও ধর্মের স্হান থাকবে না,কারণ ইহজগতের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই।”ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান এবং এর সদস্যপদগ্রহণও সেই সময়কালে ওদের কাছে ছিল সমালোচিত।৭২- এর সংবিধান আগের মতো অবস্হানে নেই।অনেক কাটছাঁট হয়েছে।ধর্মনিরপেক্ষতা পুন:স্হাপিত হলেও অনেক বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্হান এখন বিদ্যমান।এই সংবিধান কার্যকর থাকলে ধর্মের নামে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার,কুপমন্ডকতা,ধর্মীয় উন্মাদনা দেখতে হতো না।দেশ উন্নত হয়েছে।এটা স্বীকৃত বিষয়।উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে।বৈষম্য বাড়ছে ধনী-গরীবের মধ্যে।বৈষম্য বাড়ছে অঞ্চলভেদে।৭২ এর সংবিধানে বৈষম্য কমানোর রক্ষাকবজ – সমতার বিধান ছিল।ছিল সমাজতন্ত্র,মূলনীতি হিসেবে।শিক্ষা ব্যবস্থা হবার কথা ছিল একমুখী।বড় লোকের ছেলেরা পড়বে ইংলিস মিডিয়ামে,গরীব পড়বে মাদ্রাসায় আর সাধারণ ধারায় – এমনটা হবার কথা ছিল না।বিভক্ত হচ্ছে সমাজ।বিভাজন বাড়ছে।একদেশেই নতুন প্রজন্ম এক এক ভাবে গড়ে উঠছে।এর সুযোগে মোটা তাজা হচ্ছে সাম্প্রতিক অপশক্তি।আমাদের সন্তানসন্ততিরা লিপ্ত হচ্ছে একে অপরের বিরুদ্ধে – যুদ্ধে।বিঙান মনস্ক ৪ র্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম শিক্ষার সব স্তরেই এখন প্রয়োগে নিয়ে আসা অতীব জরুরি।শিক্ষার সঙ্গে বাঙালির লোকায়িত ঐতিহ্য,ধর্ম ও নৈতিকতার সংশ্লেষ’টাও প্রয়োজন।সংশ্লেষণ’টা করতে হবে আমাদের সংস্কৃতির উজ্জীবিত ধারার পথেই। সংবিধানের চার মূলনীতির উজ্জীবন শক্তি বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ইতিহাস।বঙ্গবন্ধু বাঙালির আপনজন,নতুন রাষ্ট্র গড়ার ইতিহাসের নায়ক। তাঁকে খাটো করা বা অবজ্ঞা করার ক্ষমতা ইতিহাসেরও নাই।বঙ্গবন্ধুর ডাকেই মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জীবন উৎসর্গ করেছেন। লাখো শহীদের রক্তে লেখা হয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতার সংবিধান। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফসল।বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বৈচিত্র্যময়।বহুমত ও পথের স্বীকৃতি মূর্ত হয়েছে বাংলার সাহিত্য,সংগীত,চিত্রকলা,জারি সারি গানে,যাত্রা ও মেলার উৎসবে।বাঙালির জীবনে লোকায়িত সংস্কৃতি তার আত্মা।গ্রাম বাংলার সন্তান ছিলেন ” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”।তিনি গ্রামকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে।গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতির প্রধান উপাদান ছিল অসাম্প্রদায়িকতা।

লেখকঃ অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী, পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

Exit mobile version