বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কি? নীতি নাকি হস্তক্ষেপ?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কি? নীতি নাকি হস্তক্ষেপ!/?যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি একটা দেশকে কীভাবে তার বলয়ে ব্যবহার করে! /?
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্যা এফেয়ার্স সরকার কর্তৃক আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর বেশ ব্যস্ত  সময় পার করেছেন। তিনি কয়েকটি রাজনৈতিক দল, প্রধান বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁর এই তৎপরতা যতটা না কূটনৈতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। তিনি বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলার পরও সাংবাদিকদের বলেেছন, বাংলাদেশের নির্দিষ্ঠ কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না। যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক রাখে বা জনগণের সাথে সম্পর্ক রাখে। এটা কূটনীতির ভাষা। কিন্তু কূটনীতিতো দিনের শেষে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু নয়।
দূতাবাসের কর্মকর্তা প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও বিচার ব্যবস্থার পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চেয়েছেন; অথচ তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ৩০-৩৫ জন বাংলাদেশী অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এই পর্যন্ত প্রায় দুই শতের কাছাকাছি বাংলাদেশীকে হাত পেছনে বেঁধে যুক্তরাষ্ট্র দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই অভিবাসীদের সাথে মানবাধিকার রক্ষা করছে না।
কিন্তু বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের একটা প্রধান কাজ। আর মানবাধিকার রক্ষার নামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলার সুযোগ তৈরি হয়।
এটা তাদের নীতির বিষয়। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসমূহের মধ্যে মানবাধিকার ছাড়াও রয়েছে উন্নয়ন ও সন্ত্রাসবাদের উপর জিরো টলারেন্স। বাংলাদেশের উন্নয়ন মানে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ এবং সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স মানে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ বা ঐ দেশের এলিট বাহিনী দিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডে সহযোগিতা করা। বাংলাদেশের একটা এলিট ফোর্সকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা দিয়ে তৈরি করে আবার তাদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
গত তিন বছর ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ বিষয় বাণী ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
এছাড়াও আরও কিছু বিষয় তারা যোগ করে রেখেছে ; একটা হলো শ্রম অধিকারের নামে মানবাধিকার। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে রেখেছে। তারসাথে যুক্ত করেছে, ইপিজেডে ফ্রী ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান এবং কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ রক্ষার কঠিন শর্ত। আর এইসব শর্ত টিকফা চুক্তির সাথে গাঁথা আছে। টিকফা বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তি হলেও তাতে সামরিক ক্লজ অন্তর্ভুক্ত করা আছে। এছাড়া, বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটা নীতি হলো, মুক্ত ইন্দো- প্যসিফিক সমঝোতা।
সম্প্রতি শুল্ক নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের সাথে যে চুক্তি করেছ তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ২০% শুল্ক নয় বরং নন ডিসক্লোজার শর্তাবলী। এই শর্তাবলী দিয়ে বাংলাদেশের মেধাস্বত্ত্ব, ডিজিটাল ও কৃষি বাজারে তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে। এগুলোর ফলাফল কিছু দিন পর পাওয়া যাবে।
এই ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের খনিজ, তথ্য প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও কৃষির বিনিয়োগ আসবে। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হালহকিকত জানা যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন।
চার্জ দ্যা এফোয়ার্স তাই বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। তাঁরা বাংলাদেশে একটা গ্রহনযোগ্য ও ইনক্লুসিভ নির্বাচন চায়।
বাংলাদেশকে তারা কীভাবে চায় তার উপাদান বাংলাদেশের রাজনীতিতে আছে কীনা তাও তারা নিশ্চিত হতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে একটা মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংখ্যালগুর উপর নির্যাতন তারা দেখতে চায় না। সন্ত্রাস বা জঙ্গি উত্থান দেখতে চায় না। বাংলাদেশের খনিজ সম্পদে বিনিয়োগ চায় এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি যেনো যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত না হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু না হলেও চীন হলো তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।আর যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ইন্দো- প্যাসেফিক বা কোয়াডে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকুক।বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলো এইসব শর্ত পূরণ করলে তারা তাদের সাময়িক বন্ধু হবে যদি না পারে তবে মানবাধিকার বা জঙ্গি – যেকোন উছিলায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে।
 
অন্যদিকে, বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তারা সিরিয়াস, কারণ এই পথ দিয়েই সে তিন শক্তি, চীন, ভারত ও মায়ানমারকে ধরতে পারবে। বঙ্গোপসাগরে নিয়ন্ত্রণও তার হাতে থাকবে।
ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু ও শত্রু চিরস্থায়ী নয়; বাংলাদেশেও তাই। তার সমর্থন সাময়িক পাওয়া গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা টিকবে না।
 
সামনের নির্বাচনে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র অন্যের চোখ দিয়ে দেখবে না- নিজের চোখ দিয়েই দেখবে। তাই তারা কার সাথে দেখা করলো তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি কার সাথে দেখা করলো না তাও গুরুত্বহীন নয়। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আলাপ আলোচনার পরও কোনো রাজনৈতিক দল বেশি দিন তৃপ্তি নিয়ে থাকতে পারবে না।
বাংলাদেশ যদি নিজের পথ নিজে খুঁজে না পায় – সে যদি যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করতে চায় তবে তাক শাঁখের করাতের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
 
লেখক- শরীফ শামশির 
লেখক ও গবেষক