বৃহস্পতিবার,১৮,এপ্রিল,২০২৪
35 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪
Homeশিক্ষা সংস্কৃতিইতিহাসবিশ্ব গণমাধ্যমে একাত্তর

বিশ্ব গণমাধ্যমে একাত্তর

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। রণাঙ্গনে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে গেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রণাঙ্গনের পাশাপাশি আরেকটি ক্ষেত্রে যুদ্ধ হচ্ছিল। সেই যুদ্ধ তো হয়েছিল বিশ্ব মিডিয়ায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সাংবাদিকরা লিখে যাচ্ছিলেন সংবাদপত্রে। সাংবাদিকরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের অধিকারের কথা তুলে ধরে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলেছিলেন। এর ফলে কূটনৈতিকভাবে আমাদের বিজয়ের পথ আরও ত্বরান্বিত হয়। লেখক আবদুল্লাহ জাহিদের ‘বিশ্ব সংবাদপত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বইটিতে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সংবাদপত্রের ঐতিহাসিক অনেক মুহূর্তের কথা। বিভিন্ন দেশের খবরের কাগজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে খবর ছাপা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক দলিল। সে সময়কার বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী প্রকাশিত হয়েছিল? বিভিন্ন দেশের মতবাদ কী ছিল আমাদের নিয়ে? তারা আসলেই কতটুকু জানতেন বা কতটুকু প্রকাশ করেছিলেন? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর কিংবা কৌতূহলোদ্দীপক পাঠক মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে বইটি পড়ে আশা করা যায়। বইটিতে মূলত মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে অর্থাৎ মার্চ থেকে নিয়ে শেষ হওয়া পর্যন্ত বিশ্বের ইংরেজি মিডিয়া তথা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দৈনিক পত্রিকায় যে বিবরণ প্রকাশিত হয়, তার আনুপূর্বিক বিবরণ তুলে ধরেছেন। লেখক প্রতিবেদনগুলোর মূল বক্তব্য সহজভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।

মূল পত্রিকায় কিছু ছবি বইয়ে মুদ্রিত হওয়ায় পাঠকের জন্য তা আরও বাস্তবিক হয়ে উঠবে। পাঠক বইটির শুরুতেই পাবেন নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর পাকিস্তানিদের হামলা শিরোনামে লেখা। যেখানে বিশ্ব সংবাদপত্রে বাংলদেশের নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা এসেছে। মার্চ মাস থেকেই বিশ্বের নামকরা সব পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সব খবর খুব গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় পাতার শিরোনাম ছিল ‘রায়টস ইন পাকিস্তান’। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য যে মুলতবি ঘোষণা করেন, তাতে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় যে প্রতিক্রিয়া হয় তা উঠে আসে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে। লেখক এমনিভাবে বহু ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বইয়ের বিভিন্ন অংশে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ২৫ মার্চের কালরাতের বর্ণনা বিশ্ব সংবাদপত্রে কী রূপে এসেছিল তা তুলে ধরা এবং তার প্রতিক্রিয়া এসেছে লেখকের লেখনীতে। কোনো কোনো পত্রিকায় একাধিকবার সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। পত্রিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে- নিউইয়র্ক টাইমস, সানডে টেলিগ্রাফ, সানডে মর্নিং হেরাল্ড, দ্য গার্ডিয়ান, ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, ডেইলি টেলিগ্রাফ, ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইমস অব লন্ডন, দ্য এজ (অস্ট্রেলিয়া), বাল্টিমোর সান, হংকং স্ট্যান্ডার্ড, সেন্ট লুইস ডেসপাচ ইত্যাদি। বইয়ের এক অংশে যেমন রয়েছে- লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৭ মার্চ একটি সম্পাদকীয় ছাপে, যার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ’ [Pakistan’s civil war]।

এতে বলা হয়, এতদিন ধরে যা আশঙ্কা করা হচ্ছিল, অবশেষে গভীরভাবে বিভক্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুটি মুসলিম জাতির মধ্যে গৃহযুদ্ধ দেখা দিল। গতকাল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা ত্যাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে বৃহদাকারে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শুধু এক হাজার মাইলে দূরত্বই নয়, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতেও এরা বিভক্ত। যদিও পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের এবং এরাই প্রধান উৎপাদনকারী কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা, সেনা ও ব্যবসায়ীরাই পাকিস্তানে সব নিয়ন্ত্রণ করে।

২৭ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো ডেভিড লসাকের সংবাদের শিরোনাম ছিল এ রকম : ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের অগ্নিতরঙ্গ, … শেখ একজন বিশ্বাসঘাতক, প্রেসিডেন্টের বক্তব্য’ [Civil war flares in E. Pakistan-Sheikh a traitor,’ says President]

সংক্ষেপে সংবাদটি হলো- নয়াদিল্লি থেকে ডেভিড লোসাক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, গতকাল পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছে। প্রদেশজুড়ে প্রচ যুদ্ধ ও হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।

গত রাতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী নেতা শেখ মুজিবের ভাগ্য অনিশ্চিত। বাঙালিদের বিরুদ্ধে ৭০ হাজার শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী নামানো হয়েছে। অসমর্থিত খবরে জানা যায়, শেখ মুজিব ও তার বিশ্বস্ত পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব বড় শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং সরকারি বাহিনী ঢাকা রেডিও স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সংবাদদাতা সাইমন ড্রিংয়ের ২৮ মার্চ ঢাকা থেকে পাঠানো একটি সংবাদ ছাপে। ড্রিং অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে ঢাকা থেকে বহিস্কার হওয়ার আগে এই সংবাদটি পাঠান। এর শিরোনাম ছিল- ‘সারারাত গোলাবর্ষণ শেষে সেনারা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে’  [Army take over after night of shelling].

এ রকমভাবে বইটিতে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় মুহূর্ত, পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ঐতিহাসিক মুহূর্তের বিবরণ তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। সে সময়কার সংবাদপত্রের সূত্র ধরে পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন কার কেমন ভূমিকা ছিল।

সংবাদপত্রকে সময়ের আয়না বলা যায়। কোনো একটি সময়ের সংবাদপত্র দেখে সেই সময়ের একটি প্রকৃত চিত্র পাওয়া যেতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বসমাজ বাংলাদেশ সম্পর্কে কী মনোভাব দেখিয়েছিল, এক কথায় তা সেই সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে বইটিতে।

সর্বশেষ