লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প ” তিস্তা সেচ প্রকল্প অবস্থিত। এই জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রত্যেকটি উপজেলার উপর দিয়ে তিস্তা নদী প্রবাহিত। উত্তরের জীবনরেখা এই তিস্তা নদী হলেও লালমনিরহাট জেলার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য তিস্তানদী দুঃখের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নদীর দেশীয় ব্যবস্থাপনার অভাবে বর্ষাকালে বন্যায়, নদীভাংগনে হাজার হাজার পরিবার প্রতিবছর গৃহহীন হচ্ছে। সারাদেশে গড় দারিদ্র ২০ শতাংশ হলেও লালমনিরহাটে এই হার ৪২ শতাংশ। বেকারত্বের হারও বেশি। গোটা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল,২৮টির অধিক হাই- টেক পার্ক,গভীর সমুদ্র বন্দর,পদ্মা সেতু,এল এন জি টার্মিনাল, এক্সপ্রেসওয়ে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অথচ এই জেলা তথা রংপুর বিভাগের সাথে চরম বৈষম্য দৃশ্যমান। ২০১৮ -১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পে রংপুর বিভাগের প্রায় দুই কোটি মানুষের জন্য বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের এক শতাংশের কম (০.৯৮ শতাংশ)। ফলে আমাদের অঞ্চলের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের আঞ্চলিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মূলচেতনা ছিল মানুষে- মানুষে,অঞ্চলে – অঞ্চলে বৈষম্য দূর করা। সেই উদ্দেশ্য ব্যহত হচ্ছে।লালমনিরহাট জেলায় কর্মসংস্থানের জন্য ভারী শিল্প কল কারখানা একটিও নাই। একারনে জীবন জীবিকার জন্য নদীভাংগা ও হত দরিদ্র নারী পুরুষ বাড়িঘর ছেড়ে ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলায় গার্মেন্টস এ কাজ করছেন। এমন কোনো গার্মেন্টস খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এই জেলার তথা তিস্তাপাড়ের শ্রমিক নাই৷৫০ বছরেও তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন সম্ভব হয় নাই। বরং শুষ্ক মৌসুমে ২০১৪ সালে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করেছে। ফলে শুষ্কমৌসুমে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকছে। গজলডোবা ব্যারেজ থেকে চোয়ানী পানি ও তিস্তার উপনদী থেকে যেটুকু পানি আসে সেটুকুও দোয়ানী ব্যারেজে আটকিয়ে অন্য জেলায় লক্ষ্য মাত্রার আংশিক সেচ দিচ্ছে। অতীব দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি দোয়ানী ব্যারেজ এই জেলায় হলেও এবং বর্ষাকালে বন্যা ও নদীভাংগনে মানুষ দুর্দশা গ্রস্থ হলেও শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য এক ফুট ক্যানেলও নির্মাণ করা হয় নাই। অবস্থাদেখে মনে হয় লালমনিরহাটের মানুষ বাংলাদেশের মানুষ কি না! বি সি এস পরীক্ষায় প্রশ্ন করা যেতে পারে – বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প কোন জেলায় অবস্থিত? উত্তরঃ লালমনিরহাট জেলায়। এরকম প্রশ্ন দেখলে হয়ত মনটা ভরে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্ন যদি এমন হয়- বাংলাদেশে সেচ প্রকল্প যে জেলায়, সেই জেলার মানুষ একফোঁটাও সেচ সুবিধা পায় না। এমন জেলা কোনটি? উত্তর ঃ লালমনিরহাট জেলা। তখন লালমনিরহাট জেলার মানুষ হয়ে আপনার কি অনুভূতি হবে? এই নদী রংপুর বিভাগের ৫ টি জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলাগুলির যেসব উপজেলার মধ্য দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হচ্ছে তা হলো – লালমনিরহাট জেলার মোট পাঁচটি উপজেলা পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ,আদিতমারি ও লালমনিরহাট সদর,নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা, রংপুরের গংগাচড়া,কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলা,কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলা,গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা।এই উপজেলাগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার তিস্তা দূরবর্তী অল্প সংখ্যক জমি সেচ সুবিধার আওতাভুক্ত। লালমনিরহাট জেলার মতই প্রশ্ন করা যায় – তিস্তা নদী সংশ্লিষ্ট কোন কোন জেলায় সেচ প্রকল্পের সেচের পানির ব্যবস্থা নাই? এতক্ষণে উত্তর অজানা থাকার কথা নয়। আবার যদি প্রশ্ন এমন হয় – তিস্তা নদী বাংলাদেশের কতটি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে? উত্তর হবে ঃ ১১টি। আবার প্রশ্ন – তিস্তা পাড়ের কতটি উপজেলা তিস্তা সেচ প্রকল্পের সুবিধা বঞ্চিত? সহজ উত্তর ঃ ৯ টি। এক কথায় তিস্তার দুর্দশা এলাকার মানুষ এই সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ কারনে তিস্তা তীরবর্তী কুড়িগ্রামে দারিদ্রের হার প্রায় ৭১ শতাংশ, গাইবান্ধায় ৪৭ শতাংশ,রংপুরে ৪৩ শতাংশ। তিস্তা ছাড়াও কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় আরো নদী আছে। যতবেশি নদী তত বেশি দারিদ্রের হার। কারন রাস্তা, রেল, ব্রীজ সহ সকল অবকাঠামো সংস্কার করা হয়। কিন্তু দেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা নদীর পরিকল্পিত সংস্কার কোনোদিনই করা হয় নাই। অনুরূপভাবে রংপুর বিভাগের বড় নদীগুলিও। তিস্তা সেচ প্রকল্পে ৫ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমির সেচের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও শুষ্ক মৌসুমে ৮- ৬০ হাজার হেক্টর জমির বেশি সেচ দিতে পারছে না। প্রকল্পটি যাচাই করলে দেখা যাবে এই প্রকল্পে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে। অর্থ্যাৎ উন্নতির চেয়ে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। আবার শুষ্ককালে পানির অভাবে মৃত নদীতে পরিনত হয়েছে। শুকনাকালে নদীর মূল প্রবাহ না থাকায় বর্ষায় নতুন পানি আসার সাথে সাথে পানি চলার নির্দিষ্ট রাস্তার অভাবে দিকবিদিক ছুটাছুটি করে। তখন বন্যা ও নদী ভাংগনের শিকার হয়ে নদীর দুই তীরের মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। তিস্তা নদীর এই বাস্তব অবস্থা সরকারের দৃষ্টিগোচর করা হচ্ছে না। বরং প্রতিবছর হাট- বাজার, বন্দর, স্কুল- কলেজ, মাদ্রাসা, কম্যুনিটি ক্লিনিক, পাকা রাস্তা রক্ষার নামে বর্ষাকালে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। যা অপরিকল্পিতভাবে বর্ষাকালে করার কারনে এই কাজ সফলতা বয়ে আনছে না।পানি প্রবাহের নিশ্চয়তা নাই সত্বেও তিস্তা সেচ প্রকল্প বৃদ্ধি,সংস্কার ইত্যাদি নামে বাজেট নিয়ে ব্যয় করা হচ্ছে। এখন যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে নদী ভাংগন হতে রক্ষা করার জন্য প্রতি বছর যে টাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে ব্যয় করেছেন সেই টাকা হলেই তিস্তা শাসন করা যেত।একদিকে তিস্তার দুই পাড়ের মানুষের সেচ সুবিধার জন্য এই সেচ নয় – এই সত্যটি পাশ কাটানো হয়েছে, অপরদিকে তিস্তাবাসীর জন্য সেচ প্রকল্প দেখিয়ে সেচ প্রকল্পটি চালিয়ে যাচ্ছে। তিস্তা নদীকে মৃত থেকে রক্ষা ও তিস্তাবাসীকে বন্যা ও নদী ভাংগনের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত হলে দেশের জন্য অবশ্যই খুশির, আমাদের জন্যও সুসংবাদ। তিস্তা নদীকে মেরে ফেলে, বর্ষাকালে তিস্তাবাসীকে সর্বস্বান্তের মুখে রেখে সেচ প্রকল্প আমাদের জন্য, দেশের জন্য দুঃসংবাদ বটে।
দেশীয় ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা সুযোগ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ” তিস্তা নদী সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার ” শীর্ষক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন। সর্বাগ্রে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে মৃত তিস্তা বাঁঁচবে। বর্ষার করাল গ্রাস থেকে পাঁচ জেলার ১১ উপজেলার মানুষের পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাবে। এর সাথে তিস্তা চুক্তি হলে সেচ প্রকল্প বৃদ্ধি ও সংস্কার লাভজনক হবে।রংপুর বিভাগ যে আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার, দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পিছিয়ে আছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এই বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
লেখকঃ শফিয়ার রহমান, সাধারণ সম্পাদক, তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ