রবিবার,৯,নভেম্বর,২০২৫
26 C
Dhaka
রবিবার, নভেম্বর ৯, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যমাহমুদ দারবিশ: বিতাড়িত বালক থেকে ফিলিস্তিনের হৃদয়

মাহমুদ দারবিশ: বিতাড়িত বালক থেকে ফিলিস্তিনের হৃদয়

তানভীর রুসমত: মার্চ ১৩, ১৯৪১-এ গালিলিয়ার আল-বির্ও গ্রামে জন্ম নেওয়া সেই বালক যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠেন নিঃসরণের কবি। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে যখন নাকবাহ সংঘঠিত হচ্ছে তখন তাদের হয় গ্রাম ধ্বংসের শিকার, এবং দারবিশ ও তার পরিবার নিজ জমিতে “উপস্থিত–অনুপস্থিত” হিসেবে বিবেচিত হন, অর্থাৎ নিজ ভূমিতে থেকেও তারা সেই ভূমির অধিকার হারিয়েছিলেন; রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকলভাবেই। ।

শৈশব থেকেই গ্রামবাংলার বাতাসে প্রচলিত কিংবদন্তি আর গান-সংগীতেই খুঁজে পেত তাঁর কবিতার প্রথম সুর। মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি প্রথম কবিতাসমগ্র ‘উইংসলেস বার্ডস’ প্রকাশ করেন, যা তাকে পরিচিত করে তোলে । তাঁর কালজয়ী কবিতা “Identity Card” সেই সময়কার প্রতিটি ফিলিস্তিনির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে:

Write down! I am an Arab…
And my identity card number is fifty thousand…

এই কবিতার কারণে তিনি গৃহবন্দি হন ও আন্তর্জাতিক মাল্টিভিস্তায় তাঁর কবিতা হয়ে পড়ে প্রতিরোধের এক গান। ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশে নানা ভাষায় নানান রকম মানুষের হৃদয়ে।

নির্বাসন, রাজনৈতিক অঙ্গন, সাহিত্য ও প্রত্যাবর্তন

৬০ ও ৭০-এর দশকে দারবিশ একাধারে কবি, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সম্পাদকতা-মুখী সাংবাদিক। তিনি প্রবাসের জীবন কাটান মস্কো, কায়রো, বেইরুত, প্যারিস ও তিউনিসে। ১৯৮১ সালে তিনি ‘আল-কারমেল’ সাহিত্য পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ঘোষণা-সংলাপ তাঁর হাতে লেখা হয়, যা তাকে PLO-এর নির্বাহী কমিটিতে নিয়ে আসে; কিন্তু ১৯৯৩ সালে ওসলো চুক্তির কারণে তিনি দ্রুত পদত্যাগ করেন ।

১৯৯৬ সালে তিনি অবশেষে রামাল্লায় ফিরে আসেন; প্রবাসের জীবনের পর তার প্রথম বড় প্রত্যাবর্তন  

সাহিত্য প্রকৃতি ও বৈশ্বিক সাফল্য

দারবিশের কবিতা শুধু রাজনৈতিক বা প্রতিরোধের প্রতীক ছিল না; তা ছিল প্রেম, হারানো, আত্মত্যাগ ও প্রতিচ্ছবির গল্পও। তিনি মুসলিম, বাইবেল, গ্রিক–রোমান পুরाণ ও আরব ঐতিহাসিক ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন তাঁর মেটাফোর-চিত্রে ।

তিনি ৩০টিরও বেশি কবিতা ও প্রবন্ধ–সংকলনের রচয়িতা; তাঁর সাহিত্য বিশ্বভাষায় পৌঁছেছে ২০–৩৫টি অনুবাদের মাধ্যমে। তাঁর সৃষ্টির স্বীকৃতির স্বরূপ যেমন ছিল লেনিন শান্তি পুরস্কার, ফরাসি শিল্প ও সুন্দর লেখার নাইট মর্যাদা, ল্যানন ফাউন্ডেশনের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা পুরস্কার প্রভৃতি ।

বিদায়, মাতৃপ্রেম ও স্মৃতির স্পন্দন

২০০৮ সালের ৯ আগস্ট, হৃদরোগ নিয়ে হার্ট সার্জারির পর হিউস্টনে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। অসংখ্য মানুষ রামাল্লায় তাঁর সমাধিক্ষেত্রে জড়ো হয়েছিলেন—একটি রাষ্ট্রীয় শোকাচ্ছন্নতা ঘোষণা করা হয়; তাঁর স্মৃতিতে দ্রুতই গড়া হয় দারবিশ মিউজিয়াম ও আল-বির্ও বাগান।

একটি চিরন্তন কণ্ঠস্বর

মাহমুদ দারবিশ শুধু কবি নয়—তিনি, ফিলিস্তিনের কণ্ঠস্বর, বেদনা, আশা আর সংগ্রামের প্রতীক। তাঁর কবিতা মানুষকে দখলকৃত ভূখন্ডের ভাষা শোনায়, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের স্মৃতি জাগায় ও শান্তির কথা বলে। যেমন তিনি এক সাক্ষাৎকারে যে সূচনা করেছিলেন—“অযৌক্তিকতা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা… সমষ্টিগত ইতিহাস”—তাঁর শব্দগুলো আজও বিশ্ববাসীর হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় ।

আজ এই মৃত্যুবার্ষিকীতে, আমরা স্মরণ করি তাঁর বুক ফেটে আসা কবিতাগুলোকে এবং প্রশ্রয় দেই তাঁর সাহিত্যের দীর্ঘ পথচলায়, যা এখনও ছুঁয়েছে মানুষের অন্তর।

সর্বশেষ