“চট্টগ্রাম বন্দরে শুল্ক বৃদ্ধি ও টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানির নিয়োগ : স্ট্রাটেজিক নয় দক্ষতা ও মুনাফা : মুক্তবাজার অর্থনীতির মুক্ত বন্দর ধারণায় কার লাভ বেশি”
চট্টগ্রাম বন্দরকে বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড বা লাইফ লাইন বলা হয়। ঐতিহাসিক কাল থেকে তার স্ট্রাটেজিক বা ভৌগোলিক গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু এখন বন্দরকে ঘিরে আলোচনাটা নিরাপত্তা বা ভৌগলিক নয়; এবার আলোচনাটা এসেছে বন্দরের দক্ষতা উন্নয়ন ও মুক্ত বন্দরের ধারণায় মুনাফা অর্জন। সম্প্রতি এক আলোচনায় নৌ পরিবহন সচিব আরও যোগ করে বলেছেন, এটাকে সিন্ডিকেট মুক্ত করারও প্রয়োজন রয়েছে। সিন্ডিকেটের ইঙ্গিত বিশেষ করে শ্রমিক ও পরিচালনার সাথে যুক্তদের প্রতি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি একটা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে টার্মিনাল পরিচালনার মেয়াদ শেষ হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তিনটি টার্মিনাল ৩০ বছর ও ২৫ বছরের জন্য কয়েকটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডিসেম্বরে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে তবে আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে বন্দরের পরিষেবা চার্জ গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে বহির্নোঙ্গর থেকে জেটিতে জাহাজ চালানো থেকে শুরু করে টাগবোট, ক্রেন চার্জ, বার্থিং, লোড আনলোড ও পণ্য সরবরাহ পর্যন্ত সব মিলিয়ে এই শুল্ক প্রযোজ্য হবে। এই জায়গায় ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ করেছেন, তাদের যুক্তি এতে আমদানি রফতানি খরচ বৃদ্ধি পাবে। কিছু সরকার বলছে, বন্দরের উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চল্লিশ বছর পর এই শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, খরচ বৃদ্ধির চাপ শিপিং লাইন গুলো নেবে না, আমদানি রফতানিকারকরাও নেবে না : তা গড়িয়ে পড়বে ভোক্তার উপর। আরও প্রশ্ন আসে, বন্দরতো লোকসানী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, তাহলে বাড়তি শুল্কের লাভের ভাগ কারা পাবে? অভিজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এই শুল্ক বৃদ্ধির আল্টিমেট সুবিধা পাবে ভবিষ্যতে নিয়োগপ্রাপ্ত বিদেশি কোম্পানিগুলো।
এখানে একটু সমালোচনা থেকে যাবে।
অন্যদিকে, নিউমুরিং, লালদিয়া ও বে প্রকল্প পরিচালনার জন্য যারা নিয়োগ পাবে যথাক্রমে ডিপি ওয়ার্লড, এপি টার্মিনাল ও পি এস ইন্টারন্যাশনাল লাভের অঙ্ক নিশ্চিত না করে তো বিনিয়োগে আসবে না। তাই সরকার সেই গ্যারান্টি আগে ভাগেই দিয়ে দিচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠবে বর্তমান সরকার দেশের স্বার্থেই এই বিদেশি কোম্পানিগুলোকে নিয়োগ দিচ্ছে নাকি কোম্পানির স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
এবার আসা যাক, মুক্তবাজার অর্থনীতির মুক্ত বন্দর ধারণার দিকে। চট্টগ্রাম বন্দর কি মুক্ত বন্দরে রুপান্তরিত হতে পারবে? মনে হয় এর উত্তর কঠিন। প্রথমত, চট্টগ্রাম বন্দর ধীরে ধীরে তার নাব্যতা হারাচ্ছে এবং দ্বিতীয়ত এখনো বন্দর সরকারি ব্যবস্তাপনায় পরিচালিত হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষের ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে।
অন্যদিকে, নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, বন্দরের টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় বিদেশি বিনিয়োগ ও পরিচালনা স্ট্রাটেজিক বা নিরাপত্তার ঝুঁকি আনবে না। এটা আপাত সত্য : সর্ব সত্য নয় কারণ চট্টগ্রাম বন্দর একটা আঞ্চলিক হাব হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। চীন, ভারত, ভূটান ও নেপালের এই বন্দর ব্যবহারের সুযোগ আছে। ফলে এর স্ট্রাটেজিক গুরুত্বও অপরিসীম। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের রাজনীতিরও তাই একটা ভাইব্রান্ট কেন্দ্র। এই দেশে বন্দরকে কেউ রাজনীতির আর কেউ অর্থনীতির চোখে দেখে। এখানেই জটিলতা।
যাইহোক, বর্তমান সরকারের একটা দ্বৈতনীতির কথা বলে শেষ করতে চাই। সম্প্রতি সরকার একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর তা হলো ঢাকা গাজীপুর রেপিড বাস সার্ভিস বা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির খরচ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তাতে আর অর্থায়ন করবে না, সেটা সামনের নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য রেখে দিয়েছে কিন্তু বন্দরের শুল্কের বিষয়ে এবং বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্দর পরিচালনার ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্তটা দ্রুত নিয়েছে। ভবিষ্যতই বলবে কার লাভ, কার মুনাফা আর কার সিদ্ধান্ত।
লেখক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক



