Site icon নতুন কথা

রেড স্যালুট রোজা পার্কস

রোজা পার্কস

নতুন কথা ডেস্ক ॥ ‘রোজা লুইস ম্যাকলি পার্কস’-রোজা পার্কস নামেই পরিচিত। এই সাহসী প্রতিবাদী নারী নারীর কন্ঠেই প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল ইস্পাত দৃঢ় প্রতিবাদী শব্দ (I don’t) করবো না ! যে ‘করবো না’ এর আগুন মুখা ঢেউ অ্যামেরিকা সহ আফ্রিকার জনসমুদ্রে পর্যন্ত গিয়ে আঁচড়িয়ে পরে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়েছিল। এই মহীয়ষী নারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন মানবাধিকারকর্মী ছিলেন। যাকে ইউনাইটেড স্টেট কংগ্রেস অভিহিত করেছে ‘দ্য ফার্স্ট লেডি অব সিভিল রাইটস’ এবং ‘দ্য মাদার অব দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট’। ৪ ফেরুয়ারি তার জন্মদিন। ১৯১৩ সালের এ দিনেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
অ্যামেরিকার অ্যালবামা স্টেটের মন্টেগোমারি শহরে একটি বিশেষ চরম বর্ণবাদী অমানবিক আইন প্রণয়ন করেছিল সরকার। মন্টেগোমারির ওই আইন অনুযায়ী প্রতিটি বাসের প্রথম চার সারির দশটি সিট কেবল শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। বাসের একেবারে পেছন চার সারির দশটি সিট বরাদ্দ ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য। অন্যদিকে বাস ড্রাইভারদের সহায়তায় শ্বেতাঙ্গরা তৈরি করল মাঝখানের ষোলটি সিটের জন্য নিজেদের বর্ণবাদী প্রথা। সে অনুযায়ী, মাঝখানের সামনের অংশে বসবে শ্বেতাঙ্গরা, পিছনের অংশে বসবে কৃষ্ণাঙ্গরা । একটা ছোট বোর্ড দিয়ে ড্রাইভারেরা চিহ্নিত করে দিত কোন সারি পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গরা বসবে। যদি এমন হত যে, শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের সিট পূর্ণ হয়ে যাবার পর সেই বোর্ডটা পিছিয়ে আনা হত প্রয়োজনমত। পুরো বাস শ্বেতাঙ্গ যাত্রী উঠলে কৃষ্ণাঙ্গদের বরাদ্দ করা সামনের সারির চারজন যাত্রীকেই উঠে পেছনে দাঁড়িয়ে যেতে হত। কারণ সাদা আর কালো পাশাপাশি বসতে পারবে না। আর এমন অবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রী উঠলে তাকে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, আর দাঁড়াবার জায়গাও না থাকলে বাস থেকে নেমে যেতে হত। শুধু তাই নয়, শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা সামনের সিটগুলো পূর্ণ করে ফেলার পর তাদের মাঝখান দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের হেঁটে পেছনের দিকে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল! এমন অবস্থায় কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বাসে উঠতে চাইলে তাকে প্রথমে সামনের দরজা দিয়ে উঠে ড্রাইভারের কাছে ভাড়া দিতে হত। এরপর আবার বাস থেকে নেমে বাসের পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে হতো। মাঝে মাঝেই এমন হত যে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রী সামনের দরজা দিয়ে উঠে ভাড়া দিয়ে আবার নেমে পেছনের দরজা দিয়ে উঠবার আগেই ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিত। দীর্ঘ দিন ধরেই এই আইনের বিরুদ্ধে মৃদু প্রতিবাদ করে আসছিল কৃষ্ণাঙ্গরা, কিন্তু তাদের দাবি পূরণ হয় নি। কিন্তু ১৯৪৩ সালের এক দিন। রোজা পার্কস বাসে উঠে ভাড়া দিলেন। এরপর বাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে পেছনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলেন। বাসের ড্রাইভার তাকে ডেকে বলল, এভাবে যাওয়া যাবে না, বাস থেকে নেমে পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে হবে। পার্কস নামলেন বাস থেকে। পেছনের দরজা দিয়ে উঠতে যাবেন, তার আগেই বাস ছেড়ে দিল। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন পার্কস।
ডিসেম্বরের ১ তারিখ, বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা তখন ৬টা। সারা দিনের কাজের শেষে রোজা পার্কস অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য। মন্টেগোমারি সিটি লাইন কোম্পানির একটা পুরনো চেহারার বাস এলে পার্কস উঠে পড়লেন সেই ক্লিভল্যান্ড এভিনিউ বাসে। ভাড়া মিটিয়ে তিনি এসে বসলেন শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের সিট যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক তার পেছনের পঞ্চম সারির একটি সিটে। সেই চিহ্ন দেয়ার বোর্ডটি তখন ঐ চতুর্থ সারি পর্যন্তই রাখা ছিল। বাসের ড্রাইভারের সিটে আছে এক যুগ আগে বৃষ্টির মধ্যে ফেলে চলে ড্রাইভার। বাস চলছে, এক সময় শ্বেতাঙ্গদের সবগুলো সিট পূর্ণ হয়ে গেল। এম্পায়ার থিয়েটারের সামনে বাসের তিন নম্বর স্টপেজ। সেখানে থামার পর বাসে উঠল কয়েকজন সাদা চামড়ার যাত্রী। তাদের বসবার জায়গা নেই তখন। ড্রাইভার সেটা খেয়াল করে চিহ্ন দেয়া বোর্ডটা পার্কস বসা সারিতে। ড্রাইভার বসে থাকা কৃষ্ণাঙ্গদের সেখান থেকে ওদের উঠে যাওয়ার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করতে লাগল। তার কথা মত ঐ সারির তিনজন উঠে গেল। বসে রইলেন রোজা পার্কস। তাকে আবার উঠে যেতে বলল ড্রাইভার। এবারেও সিট ছাড়লে না পার্কস, শুধু একটু সরে জানলার পাশের সিটে গিয়ে বসলেন।
ড্রাইভার রেগে বললেন সাদাদের পাশে কালোদের বসার ‘নিয়ম’ নেই। তুমি দাঁড়াচ্ছ না কেন?” পার্কস জবাব দিলেন, ‘করবো না’ ! “আমার মনে হয় না আমার দাঁড়ানোর কোনো দরকার আছে।” ড্রাইভার বললেন, “ঠিক আছে। যদি তুমি না দাঁড়ালে আমি পুলিশ ডাকব এবং তোমাকে গ্রেফতার করাব।” পার্কস জবাব দিলেন, “তোমার ইচ্ছে হলে করো।” ড্রাইভার পুলিশ ডাকলে গ্রেফতার করল পার্কসকে। তিনি সেই পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন কেন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পুলিশটি জবাব দিল,“আমি জানি না, কিন্তু ‘নিয়ম নিয়মই’ এবং তোমাকে গ্রেফতার করা হলো।”
যদিও পার্কস কেবলমাত্র সাদাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটে বসেননি, বরং কালোদের সিটেই বসেছিলেন, তবুও তার বিরুদ্ধে বাসের সিটবিন্যাসের অমানবিক আইনটি ভঙ্গের অভিযোগে মামলা করা হল। সেদিন সন্ধ্যায় তাকে জামিনে বের করে আনলেন কালোদের অধিকার আন্দোলনের সংগঠন National Association for the Advancement of Colored People এর মন্টেগোমারি অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট এডগার নিক্সন ও পার্কসের বন্ধু ক্লিফোর্ড ডার।
পরদিন পার্কসের বিচারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মোট ১৪ ডলার জরিমানা করা হয়। পার্কস রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে আদালতে প্রথম বারের মত বর্ণভিত্তিক আসন পৃথকীকরণ ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেন। সেদিন ছাপানো হ্যান্ডবিলগুলো বিলি করা হয় গোটা শহরে। হ্যান্ডবিলে বাস বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাস বয়কটের আন্দোলনের একাত্ম হন প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। কালোদের চালানো ক্যাবগুলো বাসের ভাড়ার মতই ১০ পয়সা হিসেবে নিয়ে যাত্রীবহন করে। শহরের ৪০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গের প্রায় সবাই হেঁটে চলাচল করে, অনেকেরই অন্তত ৩০ কিলোমিটার হাঁটতে হয় সে দিন।
এভাবে একটানা ৩৮১ দিন চলার পর ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরের ২০ তারিখে বয়কট শেষ হল। মন্টেগোমারিতে আবার অধ্যাদেশ জারি হল, বাসে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি যে সিটে ইচ্ছে সে সিটে বসতে পারবেন। সফল হল গণআন্দোলন।
এই ঘটনার ৬০ বছরের মাথায় অ্যামেরিকার সর্ব উচ্চ আসনে বসে আফ্রিকা- অ্যামেরিকান কালো মানুষ বারাক হোসেন ওবামা সেই বাসেই বসে বিশ্ব বাসিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন অধিকার কেউ কাউকে দেয় না অধিকার আদায় করে নিতে হয় !
স্যালুট জানাই মহীয়ষী নারী রোজা পার্কস কে ! পাশাপাশি ধিক্কার জানাই আমাদের দেশের প্রীতিলতা কল্পনা দত্তদের রক্তে ভেজা ভারতবর্ষে যারা অধিকার আদায়ের রণকৌশলকে পাশ কাটিয়ে কনভেনশনাল চুক্তিতে ভারতবর্ষকে ধর্ম নির্ভর স্বাধীনতা দিয়েছিল তাদেরকে !

Exit mobile version