বৃহস্পতিবার,২৮,মার্চ,২০২৪
27 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যশ্রমিক অন্তপ্রাণ কমরেড হাফিজুর রহমান

শ্রমিক অন্তপ্রাণ কমরেড হাফিজুর রহমান

|| কামরূল আহসান ||

বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা নেতা, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি, পাট-বস্ত্র ও সূতাকল সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সাবেক সদস্য কমরেড হাফিজুর রহমান ভূইয়ার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ১২ ফেব্রুয়ারি। সময়ের আবর্তে তাঁর চলে যাওয়ায় ভীষণ শুণ্যতা অনুভব করি। যিনি সেই ষাটের দশকে একজন স্বাতন্ত্র বৈশিষ্টের ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হিসেবে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৪৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বর্তমান খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দামোদর গ্রামের ভূইয়া বাড়িতে জন্ম তাঁর। স্কুল জীবন সম্পন্ন করেছেন ফুলতলাতেই। ১৯৬০ সালে দৌলতপুরে প্রখ্যাত ‘বিএল’ কলেজে ভর্তিহন। কলেজ অধ্যায়নকালে যুক্ত হন অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়নে। ছাত্র অবস্থায় ফুলতলায় প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা কমরেড কালীপদ ঘোষের সান্নিধ্যে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। পাকিস্তান পর্বের সেই সময় আইয়ুব খানের সামরিক শাসন কাল। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ছিল। কমিউনিস্টদের অনেকেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। কমরেড হাফিজ ছিলেন ভাষানী ন্যাপের খুলনা অঞ্চলের কর্মী। বিএল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে তিনি খুলনার আযম খান কলেজে থেকে বিকম পাশ করে ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের কোন না কোন গণ সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে কাজ করতে হয়। কমরেড হাফিজ শিক্ষা জীবন শেষে নিজ গ্রামে ফিরে এসে শিক্ষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। তিনি খুলনার বটিয়াঘাটার ডেউয়াতলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাময়িক দায়িত্ব পালন করে কর্মজীবন শুরু করেন। এসময় তিনি তৎকালীন খুলনার প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসেন (যিনি পরবর্তীতে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন)। তাঁর পরামর্শেই কমরেড হাফিজ শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি খুলনার খালিশপুরের প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলে চাকুরীতে যোগ দেন। শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যার দরখাস্ত (গ্রিভেন্স) লিখে দিতেন। সেখান থেকে গ্রিভেন্স হ্যান্ডেলিং-এ হাতে খড়ি। পরবর্তীতে তিনি এই মিলের এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের সদস্য হন। তিনি দীর্ঘসময় তিনি ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ষাটের দশকের ওই সময়কাল ছিল এক ঐতিহাসিক কাল পর্ব। ছাত্র আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন কি শ্রমিক আন্দোলন সবক্ষেত্রেই সংগঠনের গণভিত্তি তৈরী হয়েছিল। একদিকে পূর্ববাংলায় আইয়ুবয়ের সামরীক শাসন বিরোধী আন্দোলন। যাকে বেগবান করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রদত্ত ছয়দফা। যা স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ রচনা করেছে। অন্যদিকে শ্রেণি পেশার বিভিন্ন দাবী আদায়ের লড়াই। শ্রমিক আন্দোলনে কমরেড হাফিজের মতো মানুষেরা যুক্ত হয়েছিলেন বলেই শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক দাবি শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে সেদিন আদায় হতে পেরেছিল। ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ (শিল্প-কারখানা সম্পর্কিত আদেশ) বাস্তবায়িত হয়েছিল। যার অন্যতম ছিল ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ও মুজুরী বিষয়। এই আদেশেই সরকার শ্রমিকদের জন্য পাঁচ মন চালের দাম সমান নূন্যতম মজুরী নির্ধারন করেছিল।
কমরেড হাফিজ যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তা ছিল অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবার। শিক্ষা জীবন শেষে নিজের সুখ সমৃদ্ধি বিলাসী জীবন গ্রহণ করতে চাইলে, তার জন্য কোন অসুবিধা হতো না। কিন্তু তিনি সে পথে যান নি। কমিউনিস্ট আদর্শে বলিয়ান এই মানুষটি শ্রমিকের সাধারণ জীবন বেছে নেন। আমৃত্যু সাম্যবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে অবিচল থেকেছেন। তাই বহুবার কর্তৃপক্ষ তাকে পদন্নোতি দিয়ে অফিসার বানাতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। ৮০ দশকে তাঁকে ‘ ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার’ এর লোভনীয় পদ দেয়ার প্রস্তাব করা হলে তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখান করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে শ্রমিক কর্মচারি ঐক্য পরিষদের (স্কপ) পাঁচ দফা দাবিতে আহুত ঐতিহাসিক ৪৮ঘন্টার ধর্মঘট খুলনা শিল্পাঞ্চলে পালনে তিনি দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৬৬ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পূনার্ঙ্গ সভ্যপদ লাভ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনায় তিনি লেলিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। এরই ধারবাহিকতা ১৯৭৮ সালে তৎকালীন ‘ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে’ যুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে লেলিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা কংগ্রেসে তিনি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। ঐ কংগ্রেসে পার্টির নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পাটির্’ গঠিত হলে তিনি খুলনা অঞ্চলের নেতৃত্বে আসেন। ১৯৮৫ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রিয় দায়িত্বে আসেন। ১৯৯২ সালে পার্টির ঐক্য কংগ্রেসে গঠিত ‘বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির’ কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৫ সালে যশোহর পার্টি কংগ্রেসে তিনি পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য নির্বাচিত হন।
পার্টির নেতৃত্বে আসলেও তার কাজের জায়গা ছিল শ্রমিক আন্দোলন। বিশেষ করে পাটকল শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজই ছিল তার মূল কাজ। পার্টির সিদ্ধান্তে, সেই যে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শ্রমিকদের মাঝেই ছিলেন তিনি। ৮০ দশকের শুরুতে যখন জাতীয়করণকৃত শিল্প-কারখানা বিশ^ব্যাংকের পরামর্শে বিরাষ্ট্রিয়করণ নীতি গ্রহণ করে সরকার তার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সচেতন করেন ও আন্দোলন গড়ে তুলেন। খুলনার শিল্পকারখানা রক্ষার আন্দোলন ও মুজুরী আন্দোলন তিনি সংগঠিত করেণ। পাটকল শ্রমিকদের মুলনেতা কমরেড আবুল বাশারের নেতৃত্বে গড়ে উঠা পাট-সুতা-বস্ত্রকল সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রিয় যুগ্ম আহবায়ক, খুলনা-যশোহর পাট শিল্প সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক হিসেবে রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের রূপকার হিসেবে খালিশপুরসহ দেশব্যাপী রাষ্ট্রায়াত্ত পাটকল রক্ষার আন্দোলনে কেন্দ্রিয় দায়িত্ব পালন করেণ। ২০০৭ সালে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি কমরেড আবুল বাশার মৃত্যুবরণ করলে কমরেড হফিজ তার স্থলাভিষিক্ত হন। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন এর ঐক্য সম্মেলনের মাধ্যমে ‘জাতিয় শ্রমিক ফেডারেশনে’ একিভূত হলে তিনি তাঁর সভাপতি নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন ও বৃহত্তর খুলনা-যশোহর শিল্পাঞ্চলে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি খুলনাতেই অবস্থান করতেন। তবে পাটকল আন্দোলনের স্বার্থে তিনি দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে নিবিড় যোগাযোগ রাখতেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের মে মাসে চট্টগ্রামের হাফিজ জুট মিলের একটি শ্রমিক সভায় তিনি যোগ দেন। এর পর ২০১৬ সালে সেপ্টেম্বর ঢাকার ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ বিরোধী একটি সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। ওই সময়ে তিনি অসুস্থ্যবোধ করেন। পরদিন খালিশপুরে শ্রমিকদের একটি সভায় তার উপস্থিত থাকার কথা তাই দ্রুত যাওয়ার জন্য সতীর্থদের নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে খুলনা যান। সেখানে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে দ্রুত তাকে স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়া হয়। তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তাকে ভারতের ‘বিএলকে’ হাসপাতালে নেয়া হয়। কিছুটা সুস্থ্যবোধ করলে অক্টোবরে দেশে ফেরেন। আবার অসুস্থ্য হলে ডিসেম্বরে তিনি আবার সেই হাসপাতালে ভর্তি হন। জানুয়ারীতে তার স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়। জানুয়ারিতে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে স্থানান্তর করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি তার জীবন অবসান ঘটে।
সম্প্রতি খুলনায় শিল্পঞ্চলের পাটকল শ্রমিকদের ১১ দফা দাবির আন্দোলন দেশব্যাপী সাড়া জাগিয়েছে। পাটকল সিবিএ ননসিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে গড়ে উঠা এই আন্দোলনের রুপকারও কমরেড হাফিজুর রহমান ভুইয়া। প্রথমে পাঁচ দফা, পরে নয় দফা ও সর্বশেষ ১১ দফার পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগর ছিলেন তিনি। তার অনুপুস্থিতি খালিশপুর তথা দেশের রাষ্ট্রয়াত্ব খাতের পাটকল শ্রমিকরা ভীষণ অনুভব করেন। আন্দোলনের সঠিক দিশা দিতে তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শী।
কমরেড আবুল বাশার এর পর ফেডারেশনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ নেতা ছিলেন কমরেড হফিজুর রহমান ভূইয়া ও কমরেড শফিউদ্দিন আহমেদ। তারা ছিলেন সংগঠনের অভিভাবক। কমরেড হাফিজ চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। কমরেড শফিউদ্দিন অসুস্থ্য হয়ে বিছানায়। তাদের অনুপুস্থিতি সংগঠনের অভিভাবকের শুণ্যতা তৈরী হয়েছে; এই শুণ্যতা পূরণ হবার নয়।
ব্যাক্তি জীবনে হাফিজুর রহমান ছিলেন অমায়িক ও শ্রমিক অন্তপ্রাণ একজন মানুষ। সদা হাস্যোজ্জল স্বেতশুভ্র কেশ আর সৌম্য দর্শন ঋজু ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। সাদা ধবধবে পঞ্জাবী ছিল তার বিশেষ পছন্দের পোষাক, খুবই স্মার্ট ছিলেন তিনি। শ্রমিকদের যে কোন সমস্যা তিনি আন্তরিকতার সাথে সমাধানের চেষ্টা করতেন। প্রয়োজনে কেন্দ্রিয় নেতাদের সাথে তিনি রীতিমত দরকষাকষি করতেন শ্রমিকদের জন্য। যে কোন সমস্যায় প্রতিমুহূর্তে তাঁর অনুপুস্থিতি মর্মে মর্মে অনুভব করি। ফেব্রুয়ারিতে জন্মেছিলেন আবার ফেব্রুয়ারিতেই চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। তার রেখে যাওয়া আদর্শ, তার অসম্পূর্ণ কাজ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমাদের উপর বর্তে গেলেন। তার মত নিবেদিত থেকে একে এগিয়ে নিতে পারলে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন তার হৃতগৌরব ফিরে পাবে। শ্রমিক আন্দোলোনের মাঝেই বেচেঁ থাকবেন শ্রমিকদের প্রিয়জন হাফিজুর রহমান ভূইয়া, লাল সালাম।
লেখক : সভাপতি, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, কেন্দ্রীয় কমিটি

সর্বশেষ