শুক্রবার,২৯,মার্চ,২০২৪
24 C
Dhaka
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতসচেতনতা ও আইন প্রয়োগের সমন্বয় করতে হবে

সচেতনতা ও আইন প্রয়োগের সমন্বয় করতে হবে

।। আব্দুর রউফ ।।

চীনে করোনা ভাইরাস সনাক্তের খবর বিশ্ববাসী জানার পর অনেক দেশ এই ভাইরাস এর বিস্তার ঠেকানোর নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে বাংলাদেশের সেই পদক্ষেপ গুলো শুধু প্রজ্ঞাপন আর কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ ছিলো। বাস্তবিক অর্থে গাল-গল্প ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। রাষ্ট্র কর্তৃক নানা পদক্ষেপ নিলেও যাদের এই আদেশ গুলো বাস্তবায়ন করার কথা ছিলো তাদের উদাসীনতা এবং কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্যের কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর পেতাম আজ প্রজ্ঞাপন জারি হয়ে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বাহিরে বের হওয়া যাবে না। মাস্ক না পরে ঘরের বাহিরে যাওয়া যাবেনা।  দোকানপাট খোলা এবং বন্ধ করাসহ নানা বিধি নিষেধ নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রনালয় প্রজ্ঞাপন জারি করতো। করোনার প্রকোপ না কমলেও ধীরে সরকার সব বিষয়ে শিথিলতা দেখানো শুরু করলো। আবার সেই প্রজ্ঞাপন এর মধ্যমে  অনেক কিছুই স্বাভাবিক করে দেওয়া হলো। সর্বশেষ জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় প্রজ্ঞাপন জারি করলো মুখে মাস্ক পরিধান করা ছাড়া কোন নাগরিক বাহিরে যেতে পারবে না। মাস্ক না পরলে জরিমানা ও শাস্তির বিধান রাখা হলো। এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রজ্ঞাপনের খরব সরকার কতজন নাগরিকের নিকট পৌঁছিয়েছে দিয়েছে? কতজন নাগরিক এই আইন মেনে চলছে? সরকার কি সেই রকম জনসচেতনতা তৈরি করতে পেরেছে? বরং শুধু প্রজ্ঞাপন জারি করে রাষ্ট্র যেন তার দায় সেরেছে।
গত কয়েক দিন আগে একটি খবর চোখে পরলো।  ১৭ আগস্ট দিনাজপুরে মাস্ক না পড়ার কারণে ১৯৯ জন মানুষকে জরিমানা করা হয়েছে। খুব ভালো কথা ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে রাষ্ট্র জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করছে। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে সেই আদালত কি প্রতিদিন তদারকি করে? সেই আদালত কি আগে জনসচেতনতা সৃষ্টি করেছে? না হঠাৎ করেই এই নিরীহ  মানুষদের  অর্থ দন্ড দেওয়া হয়েছে। কোন আইন বাস্তবায়ন করার জন্য সেই সম্পর্কে ব্যাপক হারে জনগণের মধ্যে প্রচার করা দরকার। সচেতনতা তৈরি করা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। রাষ্ট্র তো সেই কাজটি না করেই শুধু পরিপত্র জারি করে জনগণকে হয়রানি করার সুযোগ তৈরি করেছে। দিনাজপুরে মাস্ক না পরার কারণে যাদের জরিমানা করা হলো এর জন্য রাষ্ট্র দায়ী?  নাকি সেই জনগণ দায়ী এই প্রশ্নটা থেকেই যায়। এবার  আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার বাড়ির পাশে করোনার রোগী সনাক্ত হলো। আমাদের গ্রামের আরো কিছু বাড়িতে করোনার রোগী সনাক্ত হওয়ার কারণে উপজেলা প্রশাসন আমাদের গ্রামকে  রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করলো এবং চৌদ্দ দিনের লকডাউন ঘোষণা করলো। কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলো। এইবার মনে করলাম হয়তো আইনগুলো মানার জন্য জনগণকে প্রশাসন বাধ্য করবে। কিন্তু সেই প্রজ্ঞাপন শুধু কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকলো। তার প্রয়োগ আর চোখে পড়লো না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেওয়া হলো না। এবং এই প্রজ্ঞাপনের ব্যাপারে কোন জনসচেতনতা সৃষ্টি চোখে পড়লো না। ফলে মানুষের মধ্যে আইন না মানার যে প্রবণতা সেটা বেড়ে গেলো।  অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন গণমাধ্যমে তো এগুলো প্রচার করা হয়। সেখানে সরকারের দোষ কী? যে দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রতিনিয়ত বেচেঁ থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। তাদের ঘরে সংবাদ শোনার জন্য টেলিভিশনের আশা করা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু গণমাধ্যম কেন্দ্রীক প্রচারণা না চালিয়ে গ্রাম-মহল্লাতে এমনভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন সকল নাগরিক সেই বিষয়ে জানতে পারে।  রাষ্ট্র কর্তৃক কোন আইন জারি হলে সেই আইন অমান্য করার কারণে শাস্তি দিতে পারে। আইন শাস্ত্রের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে গেল।  Ignorance of law is no excuse” আইন শাস্ত্রের এই প্রবাদ বাক্যটি শত শত বছর ধরে দেশ হতে দেশে সারা বিশ্বে এক চিরন্তন সত্য বাক্যে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলায় এই বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায় আইনের অজ্ঞতা ক্ষমার অযোগ্য কিংবা আইনের অজ্ঞতা ক্ষমার কোন কারণ হতে পারে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র ধরে নিবে যে সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইনটির বিধি-বিধান সম্পর্কে নাগরিকরা জানেন। তাই যদিও বাস্তবে আপনি সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে না জেনে উক্ত আইনটির কোন বিধি-বিধান লঙ্ঘণ করেন আর পরে যদি আপনি সংশ্লিষ্ট আইনটি সম্পর্কে জানেন না বলে কোন অজুহাত দেখান, তবুও তা রাষ্ট্রের কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। আপনাকে প্রচলিত আইন ভঙ্গ করার কারণে শাস্তি পেতে হবে। এই ক্ষেত্রে সেই আইন সম্পর্কে জনগণকে জানানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সবার কাছে সেই আইন সম্পর্কে বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়ে তারপর সেই আইনের প্রয়োগে যেতে হবে। মানুষ জন্মগত ভাবেই আইন ভাঙ্গতে পছন্দ করে। উল্লেখিত বিষয়ে সঠিক প্রচারের পরেও যদি জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়,তবে সরকার আইন প্রয়োগে কঠোর  অবস্থানে যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। 
আইন দিয়ে সচেতনতা হয় না; বরং মানুষের মধ্য ভীতি সৃষ্টি করা যায়। জনসচেতনতার জন্য আইনের পাশাপাশি মানুষকে সেই বিষয়ে অবহিত করা জরুরি। তাই শুধু দায়সারা প্রজ্ঞাপন জারি নয় সেই বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার।  আর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পূর্বে অধিকার আদায়ের পন্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া জরুরী অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম পন্থা নীতির মত। এই ক্ষেত্রে শুধু মাত্র অপরাধীকে যেমন শাস্তি দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়,তেমন আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাও সেই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে বাঁধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। সর্বশেষে আইন জানা প্রয়োজন আমার স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, হয়রানি ও নির্যাতনের হাত থেকে যথার্থ প্রতিকার পাবার জন্য, আমাদের নাগরিক ক্ষমতা যাচাই ও তা প্রয়োগ করার জন্য। করোনা পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের যে ভঙ্গুর অবস্থা জনগণের সামনে উঠে এসেছে, তা থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য যারা ক্ষমতায় আছে তাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। দূর্নীতির বিরুদ্ধে  সরকার যে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা  করেছে তা শুধু কাগজে কলমে নয় ; বরং বাস্তবে রূপ দিতে হবে। সংবিধানের চার মূলনীতির সমন্বয়ে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে। আমলাতান্ত্রিকতা পরিহার করে গণতান্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। নিজ নিজ দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করণে রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা
(নিবন্ধে প্রকাশিত অভিমত লেখকের একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিগত। এটি সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে- সম্পাদক)

সর্বশেষ