সিন্ডিকেটের থাবা এবার আলু বাজারে

এই নিত্যপণ্যটিও এখন গরিব-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে

নতুন কথা প্রতিবেদন: “গ্রামের কছিমদ্দি শহরে থাকা মেয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে সবজি বাজারে ঢুকে দেখলেন শহরের ভদ্র লোকেরা ‘বাগুন’কে বেগুন বলছে। উনিও শহুরে তাল মেলাতে দোকানদারকে আলুর বদলে ১ কেজি ‘এলু’ দিতে বললেন”-সত্যিই কছিমদ্দীর গ্রামের আলু এখন ‘এলু হয়ে গেছে। চিপাগলি, চায়ের আড্ডা থেকে অফিসপাড়া আর সভা-সমাবেশের আলোচনার মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে আলু। সেলিব্রিটি হয়েগেছে সবজি বাজারের সবচেয়ে কমদামি পণ্য আলুও। কারণ চাল,লবণ ও পেঁয়াজকাÐের পর ব্যবসায়ী নামক শকুনের থাবা পড়েছে আলু বাজারে। ৩০ টাকার আলু ধুম করে দ্বিগুণ হয়ে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার আলুর সর্বোচ্চ মূল্য ৩০ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দিলেও তা মানছে না। কারণ এই বাজার সিন্ডিকেটে কারো দোহাই মানে না। প্রয়োজনে নিজেদের অযৌক্তি দাবিতে হরতাল অবরোধের হুমকিও দেয়। ফলে সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়তি দামেই আলু কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

উচ্চবিত্তদের খাদ্য তালিকায় তেমন জরুরি না হলেও গরিব, নি¤œবিত্ত ও সাধারণ মানুষের সংসারে আলুর চাহিদা অনেক। বিশেষ করে বাজারে অন্য সবজির দাম যখন চড়া তখন তাদের একমাত্র ভরসা ছিল আলু। সিন্ডিকেট শুকনের থাবায় গরিব মানুষের সেই আলুও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

কেন আলুর দাম বাড়লো?-এ প্রশ্নের উত্তরে ব্যবসায়ীরা চার কারণকে দায়ি করেছে। তারা বলছে, করোনায় ত্রাণ বিতরণ করা, উৎপাদন কম হওয়া, বন্যায় নতুন আলুর রোপণ কমে যাওয়া এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতির কারণে আলুর দাম বেড়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের এই যুক্তি মানতে নারাজ সাধারণ ক্রেতা। তাদের দাবি অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে আলুর দাম বাড়ছে। তারাই কৌশলে আলুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আর হিমাগারের মালিকরাও বলছেন আমরা শুধু সংরক্ষণ করি। ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্ব ভোগীরাই দাম বাড়াচ্ছেন। পরস্পরের এই দোষারোপের মধ্যে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আলুর মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ১৩৩ শতাংশ বেশি। ফলে “বেশি করে আলু খান, ভাতের উপর চাপ কমান”-বিভিন্ন সময়ে কর্তা ব্যক্তিদের এই বক্তব্যটিও এখন আর কাজে আসছে না। কারণ আলু আর চালের দাম এখন সমানে সমান। তাই ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন বলেছেন, “মানুষের থালায় ভাত কমেছে, আলুর দাম বাড়ায় পেটপুরে খাওয়ার জন্য আলু ভর্তাও জুটছে না”।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের দেশে উৎপাদিত পণ্যটির দাম স্বাধীনতার আগে তো নয়ই, স্বাধীনতার পরও এত বাড়ে নি। হিমাগার সমিতি জানিয়েছে ডিসেম্বরে শেষ হওয়া মওসুমে ৮৫ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ২২ লাখ টন। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝিতে আবার নতুন আলু আসতে শুরু করবে। আলুর আরো মূল্যবৃদ্ধির আশায় অনেকে হিমাগার থেকে আলু নিচ্ছেন না। আর মধ্যসত্বভোগীরা তো আছেই। তারাও মূল্যবৃদ্ধিতে সবসময় এগিয়ে।

অন্যদিকে সরকারি বিপণন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশনও (টিসিবি) বলছে দেশে পর্যপ্ত আলু মজুত আছে। চাহিদার চেয়ে ৩২ লাখ টন বেশি মজুত থাকার পরও আলুর দাম বৃদ্ধিতে তারা বিস্মিত। সাধারণ মানুষ ও বাজর বিশ্লেষকরা নিত্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিকে বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতাকেই দায়ি করছেন।

তাছাড়া করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে অসাধু বাজার সিন্ডিকেট। সুযোগ বুঝে তারা বিনা কারণেই আলুর দাম বাড়িয়ে মানুষের পকেট কাটছে। মহামারি করোনার কারণে বেকার কর্মহীন, চাকুরিচ্যুত নি¤œ আয়ের মানুষের নাভিশ^াস অবস্থা। তদুপরি দ্রব্যমুল্যের এই পাগলা ঘোড়া তাদের আরো বিপর্যস্ত করে তুলেছে। চারদিকে খরচ কাটছাট করেও তারা সংসার চালাতে পারছেন না। কৃষি মন্ত্রণালয় সুত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর আলুর চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ টন। এর বিপরীতে গত বছর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টন। চাহিদা মেটানোর পরও উদ্ধৃত্ত থাকবে ৩২ লাখ টন। তাই আলুর দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তার পরেও আলুর দাম বাড়ছে কেন! এখানেই সিন্ডিকেটের খেলা। এ খেলা ভাঙতে হবে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা না হলে সাধারণ মানুষের অবস্থা আরো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়ে যাবে। আলু বাজারের আগুনে ঘর পোড়ার মধ্যে পোড়া আলু খাওয়ার মজা নিতে পারে অন্যকোনো অপশক্তি। তার আগেই সাবধান হতে হবে সংশ্লিষ্ট সকলকে।