মঙ্গলবার,১৯,মার্চ,২০২৪
32 C
Dhaka
মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪
Homeঅনুসন্ধিৎসাপ্রতিবেশসুপরিকল্পিত বাসস্থান

সুপরিকল্পিত বাসস্থান

মৌলিক সমস্যার সমাধান – ১

।। ড. ইঞ্জিনিয়ার এস,কে, আহমেদ কামাল ।।

ড. এস কে আহমেদ কামাল

মানব জাতির পৃথিবীতে উদ্ভবের সাথে সাথে বাসস্থানের প্রয়োজন হয়েছে এবং এর সাথে সাথে উদ্ভব হয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন আর তা রক্ষা করার প্রবৃত্তি। এই বাসস্থান গুলিকে একত্রিত হিসাবেই গড়ে উঠেছে নগর, বন্দর, জনপদ। একই সাথে এই বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় ভুপৃষ্ঠের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ ‌নিয়ে মানুযে মানুষে হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জন আর প্রভাব বিস্তারের অতিরিক্ত লোভের পরিনতিতে সংঘর্ষ আর যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে কত মানবজীবন আর জনপদ। শুধু তাই নয়, এই জনপদগুলির কর্তৃত্ব নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনেক বিবাদ এবং মতবাদ। কোন বিশেষ জনপদের অভ্যন্তরে পরস্পরকে বিভিন্ন সেবা প্রদানের মুল্যায়ন আর বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে প্রঢলিত হয়েছে অর্থ আর তার সাথে সাথে অর্থনীতি। সৃষ্টি হয়েছে সমাজে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ। এর মধ্যে কেবলমাত্র সমাজবাদই পেরেছিল স্বল্প সময়ে সমাজে প্রায় সকল পরিবারকে নিজস্ব বাসস্থান দিতে। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের তথা ব্যক্তিবাদের কাছে সমাজস্বার্থ তথা সমাজবাদ সাময়িকভাবে পরাজিত হয়েছে। কেবলমাত্র প্রাক্তন সমাজবাদী রাষ্ট্রগুলিতেই প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব মালিকানাতে বাসস্থান আছে। অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিতে প্রায় শতকরা ৫০ শতাংশেরও নিজস্ব মালিকানাতে বাসস্থান নাই আর যাদের আছে তাদের মধ্যেও বেশির ভাগেরই ব্যাংকের কাছে ঋণ বাবদ বন্ধককৃত। এই মৌলিক অধিকার হিসাবে গৃহিত বাসস্থানের অধিকার সর্বজন স্বীকৃত হলেও সেটা সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে বলতে গেলে কোন সরকারের তেমন কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নাই। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগেই তা সুনিশ্চিত করার পরিকল্পনা করতে হয়। আমার মতে প্রতিটি সরকারের বাজেটে তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাসস্থান প্রকল্পে  বরাদ্দ রাখতে হবে।

প্রশ্ন স্বাভাবিক যে, কি ধরনের বাসস্থান সর্বোপযোগী? প্রতিটি মানুষ তার বিশেষ পছন্দ অনুযায়ী বাসস্থানের পরিকল্পনা করে। কিন্তু প্রত্যেকেব পছন্দ অনুযায়ী বাসস্থান নির্মাণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারীভাবে বাসস্থান নির্মাণ করতে হলে সেখানে যত বেশী সম্ভব মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। তখনই জনগণ সেই সরকারকে জনকল্যানকামী সরকার বলবে। প্রশ্ন হলো আদৌ কি সেরকম সরকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব? আমার মতে বাংলাদেশের জন্য সম্ভব। বাংলাদেশের জলবায়ুর কারনেই তা সম্ভব। বাংলাদেশের জলবায়ুর এবং আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য সহজেই খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি একটি বাসস্থানেই উৎপাদন সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সুপরিকল্পিত বাসস্থান এবং মানুষের জীবনযাত্রা ও চিন্তাধারার সামান্য পরিবর্তন, যা মোটেও কঠিন নয়, যদি মানুষ তার সুফল বুঝতে পারে।

সুপরিকল্পিত বাসস্থান আরও একটি বিশেষ কারণে প্রয়োজন। তা হলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশে জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অনেকে এটাকে আশীর্বাদ মনে করেন, কারন এর ফলে সস্তা শ্রম বিদেশে রপ্তানি করে এবং পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিয়ে অধিক বিদেশী মুদ্রা অর্জন করে দেশের ভেতরে নানা উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু ভবিষ্যতে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলি ক্রমান্বয়ে তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে বিদেশী শ্রমিক আর নিবে না। আর রোবোট এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে পোশাক শিল্পেও শ্রমিক চাহিদা কমে যাবে। কাজেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে বাংলাদেশে সকলের কর্মসংস্থান করা যাবেনা। তাতে সমাজে ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি হবে। কিন্তু জনসংখ্যা জোর করে নিয়ন্ত্রণ না করে স্বেচ্ছায় যেন মানুষ তা করে, সেইজন্য সুপরিকল্পিত বাসস্থান তৈরি করলে ছোট ফ্ল্যাট বাসায় সন্তান সীমিত রাখতে নীতিমালা অনুযায়ী সন্তান নিতে হবে। যেমন প্রতিটি ফ্ল্যাট এমন একজন মেয়ের নামে বরাদ্দ হবে, যার কেবলমাত্র একটি সন্তান থাকবে; তাকে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পাস হতে হবে এবং হাঁস, মুরগী, গরু পালনের তিন মাসের একটি ট্রেনিং নিতে হবে। আরেকটি সন্তান নেয়ার আগেই তাকে অনুরূপ একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য ফ্ল্যাটের দামের টাকা নির্মাণ প্রকল্পে প্রদান করতে হবে, অন্যথায় দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময় তার স্থায়ী বন্দ্ধ্যাকরণ সম্পন্ন করতে হবে। এভাবে ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে এবং বেকার সমস্যার সমাধান হবে। পরবর্তীতে প্রয়োজনবোধে সন্তান সংখ্যা দুইটিতে উন্নীত করা যেতে পারে।

প্রতিটি মানুষের জীবনেই খাদ্যের সাথে সাথে বাসস্থানের অধিকার ও প্রয়োজন আছে। অন্যথায় একজন মানুষ তার জীবনে সর্বদাই অসুখী থাকে। উপরন্তু যেখানে মানুষের বাসস্থান থাকে, সেখানেই মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর বাসস্থানের মালিকানা না থাকার ফলেই মেয়েরা নানা অত্যাচারের সম্মুখীন হয়।  বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে মুলতঃ শহরগুলোতে নজর দেয়া হয়। কিন্তু গ্রামের বিপুল জনগোষ্ঠী অবহেলিত থেকে যায়। ফলে গ্রাম থেকে শহরে যেতে সবাই আগ্রহী হয়। তাই গ্রামের উন্নয়ন কার্যক্রমে ও বাসস্থানের নির্মাণে সরকার নজর দিলে শহরগুলোতে জনসংখ্যার চাপ কমবে।

পরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণে শহর এলাকায় এবং গ্রামীণ এলাকায় ভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা হতে হবে। কারণ শহর এলাকায় জমির পরিমাণ কম এবং জনসংখ্যা বেশী। শহর এলাকায় কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বেশি, তবে গ্রামে বসবাস করা বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে গ্রামে থেকেও শহরের প্রায় সকল সুবিধা ভোগ করার সুযোগ থাকে। তাই শহরে বাসস্থানের বদলে গ্রামে পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যবস্থা নিলে কর্মহীন লোকজন গ্রামে বসবাস করতে আগ্রহী হবে। যেহেতু বাংলাদেশের জমির পরিমাণ কম, তাই গ্রামে পরিকল্পিত বাসস্থানের নির্মাণ করতে পাঁচ তলা ভবন এর পরিকল্পনা করতে হবে যেন লিফটের প্রয়োজন না হয়। সেক্ষেত্রে বাসস্থান নির্মাণে জমির সাশ্রয় হবে। গ্রাম গুলো হয়ে উঠবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহর। অন্যদিকে শহরে নুন্যতম ছয় থেকে দশ তলা বহুতল ভবন নির্মাণ করতে উৎসাহিত করতে হবে। তবে শহরের ফ্ল্যাটগুলিতে কেবলমাত্র বসবাসের সুবিধা থাকলেই চলবে, কিন্তু গ্রামের ফ্ল্যাট গুলিতে সব ধরনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার ব্যাপারেও পরিকল্পনা করতে হবে। অবশ্য শহরে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা নিয়ে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হবে। গ্রামে তা তত কঠিন হবে না কারন জমির অধিকরণ সহজ হবে যদি প্রতি পাঁচ কাঠা জমির মালিককে অথবা কমপক্ষে একটি ফ্ল্যাট তৈরিতে খরচের অর্ধেক প্রদানকারীদের একটি ফ্ল্যাট শর্ত্ত সাপেক্ষে বরাদ্দ দেয়া হয়। তাই সুপরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণে গ্রামকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি জমির অধিকরণ হলেও কোনো ক্ষতি নাই কারণ প্রতিটি ফ্ল্যাটেই খাদ্য উৎপাদন হবে।

যদি গ্রামীণ বাসস্থান প্রকল্পে বাংলাদেশে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, তবে বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা প্রায় ৫০ কোটি টাকা পাবে। এই ৫০ কোটি টাকায় ৫০ টি ৫ তলা বিল্ডিং বানানো সম্ভব যদি দুর্নীতি না হয়। প্রতিটি বিল্ডিং এ ১৬০০ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাট থাকবে যেখানে প্রতিটি ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরে ৬০০ বর্গফুট জায়গায় টবে সবজী ও মাছ চাষ, প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য বরাদ্দ ৪০০ বঃফূঃ জায়গায় প্রথম তলায় গাভী পালন ও ছাদে টবে ফলের গাছ লাগানো ও মুরগী পালন করা হবে। সোলার প্যানেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গরুর গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপাদন হবে। ফলে প্রতিটি ফ্ল্যাট খাদ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তে স্বয়ংসম্পুর্ন হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে পানীয় জলের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। ব্যবহৃত পানি সবজি টবে ব্যবহার করতে হবে। এভাবে প্রতি বছর ৫০*৪*৫০০= ১,০০,০০০ মেয়েকে তথা পরিবারকে স্বয়ংসম্পুর্নতার আওতায় আনা সম্ভব হবে। যদি কোন মেয়ে বরাদ্দ পাওয়ার পর সেখানে নিয়মানুযায়ী বসবাস না করে, তবে তার বরাদ্দ বাতিল হবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি ইউনিয়নে ৫০*৪=২০০ টি পরিবারকে নিয়ে একটি স্বনির্ভর পাড়া গড়ে তুললে তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে অন্যদেরও অনুরূপ ফ্ল্যাট তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করবে।  গ্রামে যারা ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের ফ্ল্যাট নির্মাণ করবে, তাদের দুই বছরের জন্য‌ শর্ত্ত সাপেক্ষে বিনা সুদে ঋণ দেয়া হবে। পরবর্তী বছরগুলোতে অপরিশোধিত ঋণের উপর প্রতি বছর ২% হারে সুদ বৃদ্ধি পাবে। তবে পাঁচ বছরের মধ্যেই মুল ঋণ পরিশোধ করলে সুদের কিছু অংশ মওকুফ করা যেতে পারে।  বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট এবং এই বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের কিছু অংশ জনগনের বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। এভাবে মৌলিক চাহিদা পূরণ করা বাসস্থানের বদৌলতে সরকারের বেকার ভাতা প্রদানের কোন প্রয়োজন থাকবে না। জমি বা বাড়ির মালিকানা নিয়ে কোন সমস্যা থাকবে না কারন একটি সন্তানই তার উত্তরাধিকার হবে।

অবশ্যই এই প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতিতে ঢরম শাস্তির বিধান থাকতে হবে। অন্যথায় নির্মাণ খরচ বেড়ে যাবে। দারিদ্র্য বিমোচন নয়, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে যারা এই প্রকল্পে আসবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্মাণ খরচ কমানোর জন্য রিসার্চ করতে হবে এবং ব্লক পদ্ধতিতে নির্মাণ কাজ করতে হবে। যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদনে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হবে, তাই প্রতিটি বাসস্থান প্রকল্পে একজন ইলেক্ট্রিক্যাল সোলার প্যানেল টেকনিশিয়ান থাকবে। উৎপাদিত বিদ্যুতের অতিরিক্ত অংশ জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সঞ্চারিত হবে দিনের বেলায়, আর রাতে বিদ্যুৎ আসবে জাতীয় গ্রিড থেকে। ফলে অহেতুক ব্যাটারী খরচ লাগবে না। উপরন্তু, দেশেই সোলার প্যানেল তৈরিতে বিনিয়োগ করতে হবে। তাতে সোলার প্যানেলের খরচ কমে যাবে। এভাবে সুপরিকল্পিত বাসস্থান প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে অনেক নতুন কর্মসংস্থান হবে এবং সকলের জন্য আধুনিক জীবন যাপন করার সম্ভাবনা তৈরি হবে।  এভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারলে মানুষ তার অন্যান্য চাহিদাগুলো নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী মেটাতে পারবে। এরপর মানুষের সুস্বাস্থ্য ও সুখ নির্ভর করবে নিজস্ব জীবন যাপন পদ্ধতির উপর সরকারের উপর নয়।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

(নিবন্ধে প্রকাশিত অভিমত লেখকের একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিগত)

সর্বশেষ