বৃহস্পতিবার,২৮,মার্চ,২০২৪
27 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪
Homeশিক্ষা সংস্কৃতিলোক সাহিত্যহুমায়ূন—প্রয়াণদিবসে শ্রদ্ধা হুমায়ূন আহমেদ: আশ্চর্য অনুভূতির আখরে লেখা নাম

হুমায়ূন—প্রয়াণদিবসে শ্রদ্ধা হুমায়ূন আহমেদ: আশ্চর্য অনুভূতির আখরে লেখা নাম

শৈশবে আমি খুব ‘কেরছা’ শুনতে চাইতাম। কেরছা মানে কিসসা। গল্প। আমাদের দাদিকে আমরা ডাকতাম বু। বু সম্ভবত বুবু থেকে এসেছে। বু রাত জেগে আমাদের কেরছা শোনাতেন। গহর বাদশাহ-বানেছা পরির কেরছা। ডালিম কুমার-পঙ্খীরাজ ঘোড়ার কেরছা। সোহরাব-রুস্তমের কেরছা। গল্প শোনার সেই শুরু।

গল্প বলার নানা মাধ্যম রয়েছে। সৃষ্টিশীল সব মাধ্যমের কাজই মূলত গল্প বলা। তা সে লেখা থেকে আলোকচিত্র হোক কিংবা সিনেমা থেকে ভাস্কর্য। আমাদের শৈশবে অবশ্য গল্প শোনার মাধ্যম ওই নানি, দাদি আর মা। সেখানে রেডিও-টেলিভিশন নেই। ক্লাসের বাইরের ‘আউট’ বই পড়ার সুযোগও তেমন নেই। ফলে মুখের কেরছা আর ক্লাসের বাংলা বইয়ের গল্প পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যেতাম আমি। আমার তখন আরও গল্প চাই। অনেক অনেক গল্প। এক গল্প বারবার শুনতে আমার ভালো লাগে না। তাই আমার নিত্যনতুন গল্প চাই।

সেবার আমার মায়ের জন্য আব্বা শাড়ি কিনে আনলেন। শাড়ি খুলতেই দেখি শাড়ির ভেতর পুরোনো দিনের পত্রিকা। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সেই পত্রিকাভর্তি নানা সংবাদ আর ফিচার। এমনকি সেসব ফিচারজুড়েও নতুন নতুন গল্প। পত্রিকার নানা খবরও আমার কাছে গল্প হয়ে উঠতে লাগল! নতুন ধরনের গল্প। আমি তা গোগ্রাসে গিলতে লাগতাম। কিন্তু নতুন গল্পের নেশা অস্থির করে রাখল আমাকে। যেখানে যা পাই পড়ে ফেলি। কিন্তু গল্পের তেষ্টা যেন মেটে না। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ রোদের আস্ত এক দুপুর সারাক্ষণ তড়পাতে থাকে।

তবে সেই তেষ্টা মিটে গেল অদ্ভুতভাবে।

মা তখনো গল্পের বই পড়েন। কিন্তু তা পড়তে হয় আমার দাদির চোখ এড়িয়ে। মাটির চুলায় খড়ি ঠেলতে ঠলতে আম্মা লুকিয়ে বই পড়েন। চুলোয় তাঁর ভাত নরম হয়ে যায়, তরকারি পুড়ে যায়। দাদি তেড়েফুঁড়ে আসেন, ‘বিয়াশাদি হইছে, দুই বাচ্চার মা হইছ, এহন আবার পড়াশোনা কইরা জজ-ব্যারিস্টার হওনের সাধ হইছে!’

দাদি যে আমার মাকে অপছন্দ করেন, তা নয়। বরং তাঁদের সম্পর্ক মা-মেয়ের মতোই অকৃত্রিম। সেখানে মায়ের বই পড়ার এই অভ্যাস দাদির চোখে বাহুল্য। সময় নষ্ট। মেয়ে মানুষের এত পড়ে কাজ কী! বিয়ের পর ঘরকন্নাটাই আসল। কিন্তু আমার মায়েরও যে গল্প শোনার নেশা! সেই নেশা আমাকেও এলোমেলো করে দিল। আম্মা রাতভর গল্প শোনান। সেসব গল্পের বেশির ভাগই তাৎক্ষণিক মুখে মুখে বানানো। কারণ, এক গল্প দুবার শুনতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু এত এত নতুন গল্প আম্মা পাবেন কই?

ছোটবেলায় আমার খুব জ্বর হলো। বিছানায় শুয়ে শুয়ে গোঙাচ্ছি। সারাক্ষণ আম্মার আঁচল টেনে ধরে পাশে বসিয়ে রাখছি। যেন আম্মার আঁচলের ঘ্রাণে আমার জ্বর সেরে যাবে। কিচ্ছু খেতে পারি না। চারপাশজুড়ে যেন মাছের উৎকট আঁশটে গন্ধ। খাবার দেখলেই বমি চলে আসে। আম্মা বাংলা বইখানা আমার হাতে তুলে দেন। আমি পাতা উল্টাই। গল্প দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায় যদি! খানিক শরীরও। কিন্তু হয় না। এই বইয়ের সব গল্পই আমার পড়া। পড়া গল্প আর কতবার পড়া যায়! পড়া গল্প পড়তে ভালো লাগে না।বইখানা আমি শেষ করলাম পরদিন রাতে। আমার চোখের কোল বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। আমি সেই অশ্রু মুছে বইখানা উল্টেপাল্টে দেখলাম। বইয়ের নাম ‘অপেক্ষা’।

সন্ধ্যায় বার দুই বমি করলাম। শুনে পাশের বাড়ির এক বড় আপা এলেন থার্মোমিটার নিয়ে জ্বর মাপতে। তিনি তখন ডিগ্রি ক্লাসে পড়েন। তার হাতে একখানা বই। মাঝখানে পৃষ্ঠা ভাঁজ করে চিহ্ন দিয়ে রাখা। আম্মাকে বললেন মাথায় জলপট্টি দিতে। অন্ধকারে কেরোসিনের কুপি নিয়ে পুকুর থেকে পানি আনতে গেলেন আম্মা। সঙ্গে আপাও। তাঁর তখন বইখানা আমার পাশে রাখা। আমি পাতা ওল্টালাম। এক পাতা, দুই পাতা, তিনি পাতা। তারপর ওল্টাতেই থাকলাম।

এরপর আম্মা এলেন, মাথায় পানিপট্টি দিলেন। বড় আপা বইখানা চাইলেন। আমি তাকালাম না অবধি। আম্মা সম্ভবত চোখের ইশারায় তাঁকে বইখানা রেখে যেতে বললেন।

তারপর ঘোরগ্রস্ত এক কিশোরের জগৎ ও জীবন ডুবে যেতে থাকল এক অদ্ভুত বিস্ময়ে। সেই বিস্ময়ের নাম ‘হুমায়ূন আহমেদ’!

বইখানা আমি শেষ করলাম পরদিন রাতে। আমার চোখের কোল বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। আমি সেই অশ্রু মুছে বইখানা উল্টেপাল্টে দেখলাম। বইয়ের নাম ‘অপেক্ষা’। সেই রাতে ঝুমবৃষ্টি শুরু হলো, ঝোড়ো হাওয়ায় ঘর নড়বড় করছে। আম্মা পাশে বসে উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে আছেন। কেরোসিনের কুপির আলো থরথর করে কাঁপছে। সেই কম্পমান আলোয় আমি আবার পড়তে শুরু করলাম বইখানা। তারপর দিন আবার। তারপর আবার। শোনা হয়ে যাওয়া, কিংবা পড়া হয়ে যাওয়া গল্প আর শুনতে বা পড়তে না চাওয়া সেই একগুঁয়ে কিশোর ডুবে যেতে থাকল একটি মাত্র গল্পে, একটি মাত্র বইয়ে—বারবার, বারবার। সেই ডুবে যাওয়া থেকে তার আর ভেসে ওঠা হলো না।

একজন হুমায়ূন আহমেদ তাকে অন্য এক গল্পের জগতে বুঁদ করে রাখলেন। বইয়ের পর বই। গল্পের পর গল্প। চরিত্রের পর চরিত্র। যেন এক অদ্ভুত অপার্থিব ঘোর। সেই ঘোরে ঘোরগ্রস্ত হয়ে রইল প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

বড় হতে হতে আবিষ্কার করলাম, এই জীবন ও জগৎ মূলত গল্পের। এখানে যা কিছু ঘটে, তার সবই গল্প। কিন্তু সেই গল্পকে উপলব্ধি করতে পারতে হয়। উদঘাটন করতে জানতে হয়। আর জানতে হয় গল্প বলতেও। কিন্তু তা পারেন খুব অল্প কিছু মানুষ। ফলে বেশির ভাগ মানুষ কেবল গল্প শোনেন। আর খুব অল্প কিছু মানুষ গল্প বলে যান। আর সেই অল্প কিছু মানুষের মধ্যেও অনন্য কিছু মানুষ হয়ে ওঠেন গল্পের সত্যিকারে জাদুকর। তাঁদের গল্প বলার জাদুতে, সম্মোহনী শক্তিতে বুঁদ হয়ে থাকেন অসংখ্য মানুষ। তাঁদের সেই গল্প বুকের ভেতর অজস্র প্রজাপতির উড়ে যাওয়া ডানায় লিখে দিতে থাকে জীবন ও জগতের অজস্র জিজ্ঞাসা আর উত্তর। তীব্র অনুভূতির আখ্যান। হুমায়ূন আহমেদ সেই অনন্য মানুষ, যিনি বাঙালি পাঠকের বুকের গহিনে এঁকে দিয়েছেন অন্তহীন অনুভবের রেখাচিত্র। সেই রেখাচিত্র জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

তাতে ক্রমেই আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে আশ্চর্য অনুভূতির আখরে লেখা নাম—হুমায়ূন আহমেদ!

সাদাত হোসাইন

সর্বশেষ