সেই পুরনো বাদ্য-লোকসানের দায় শ্রমিকের
এমএইচ নাহিদ : কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। টেকসই উন্নয়নে কৃষির বিকল্প নেই-চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে করোনা মহামারী। ইঙ্গিত দিয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় কৃষির বিকল্প নেই। সবার আগে নজর দিতে হবে অর্থনীতির এই প্রাণভোমরার দিকে। কিন্তু এদিকে নজর কই! উল্টো নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির খপ্পরে ক্রমেই ধ্বংস করা হচ্ছে কৃষিভিত্তিক ভারীশিল্প। বন্ধ করা হচ্ছে কৃষি উন্নয়নের দুয়ার। প্রধান অর্থকরী ফসল পাটকে ধ্বংস করতে রাষ্ট্রয়াত্ত পাটকলের কফিনে পেরেক মারার পর এবার তৈরি করা হচ্ছে চিনিকলের মৃত্যুযাত্রার কফিন। ইতোমধ্যে ১৫টি’র ৬টি চিনিকলের আখ মাড়াই বন্ধ করা হয়েছে। সেই পুরনো বাদ্য-লোকসানের দায় শ্রমিকের। বার বার শ্রমিকের কাঁধেই দোষ চাপিয়ে দায় এড়াতে চান কর্তাবাবুরা। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি-লুটপাট, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, মাথাভারি প্রশাসন ও পুরোনো যন্ত্রপাতির কারণে যে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর লোকসানের বোঝা বইতে হচ্ছে তা একবারও স্বীকার করেন না। এসব খতিয়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করেন না। বরং শ্রমিকের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ছেড়ে দেন ব্যক্তি মালিকানায়। ফলে ধ্বংস হচ্ছে কৃষিভিত্তিক ভারী শিল্প। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যাত্রায় হাবুডুবু খাচ্ছেন এসব শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক ও কৃষক। আর মুনাফা লুটার নেশায় মুচে তা দিচ্ছেন লুটেরা সিন্ডিকেট।
রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকা ১৮টি চিনিকলের মধ্যে আগেই ৩টি চিনিকল ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। গত ১ ডিসেম্বরে বাকি ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি চিনিকলে ২০২০-২১ অর্থবছরে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষনা নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি)। কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর, শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ ও পঞ্চগড়-এই ৬টি চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধের পিছনে বিএসএফআইসি’র অজুহাত শ্রমিকদের কারণে ফি বছর লোকসান গুণতে হচ্ছে। কর্তপক্ষ বলছে, চিনিকল বন্ধ করা হয়নি। আবার এও বলছে, বিদেশি বিনিয়োগে জরাজীর্ণ কারখানাগুলো আধুনিকায়ন করা হবে, চিনির পাশাপাশি স্পিরিট, অ্যালকাহোলসহ অন্যান্য উপজাত পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে চিনিকলগুলো বন্ধ করা হলো। আসলে পাটকলের মতো চিনিকলও ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার গভীর চক্রান্ত কিনা-সে প্রশ্ন চিনিশিল্প শ্রমিক, আখচাষী ও সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের।
কর্তপক্ষ চিনিকলগুলোর লোকসানের কথা বললেও আখচাষীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি ১ মণ আখ থেকে সাড়ে ৩ কেজি চিনি, ৬ কেজি মোলাসেস, ১৪ কেজি ব্যাগাসে এবং ২ কেজি প্রেসম্যাড উৎপাদিত হয়। এসবের মোট বাজার মূল্য ৪৬২ টাকা। কৃষক একমণ আখে পান ১৪০ টাকা। এ হিসেবে উৎপাদনে মিল মণপ্রতি উদ্বৃত্ত ৩২২ টাকা পাওয়ার পরেও কেন লোকসান হয়! আর শ্রমিকরা বলছেন, মিলে মাথাভারি প্রশাসন থাকায় শ্রমিকের তুলনায় তাদের বেশি বেতন দিতে হয়। ঋণের সুদ দিতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কৃষকদের দেওয়া ঋণ ৯৯ ভাগ আদায় হলেও ঋণ পরিশোধ করা হয় না বছরের পর বছর। সুধের বোঝা বাড়তেই থাকে। এছাড়া পুরনো যন্ত্রপাতির কারণেও আখ থেকে চিনি আরোহণ কম হয়। অন্যান্য দেশে চিনি আরোহণ বেশি হয়। সব মিলিয়ে আমাদের দেশে চিনির উৎপাদন খরচ বেশি। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ না নিয়ে শ্রমিকের ওপর দোষ চাপিয়ে চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, আখ ক্রয় থেকে বিপণন-প্রতিটি ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি-লুটপাট, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা এবং পাহাড়সম ব্যাংক ঋণের সুদের কারণে চিনিকলগুলোকে লোকসান গুণতে হচ্ছে। রয়েছে প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোগ গ্রহণের অভাব।
আখচাষী ইউনিয়ন ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, ক্ষমতার প্রভাবে বিনাপ্রয়োজনে অধিক জনবল নিয়োগ, পরিবহণগুলো কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতাদের ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার, জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত বিল আদায়সহ নানা কারণে চিনিকল লোকসান গুনছে।
এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী একটি চিনিকলে চিনি উৎপাদন খরচ কেজিতে ১৮৬ টাকা। মোট ব্যাংক ঋণের সুদ অনুযায়ী উৎপাদন খরচ ৩১২ টাকা। সেই চিনি ব্রিক্রি হয় ৫৩ টাকা ৩৫ পয়সায়। উৎপাদন খরচের এই বিশাল ব্যবধানের জন্য শ্রমিক নয়, প্রশাসনের অযোগ্যতা ও দুর্নীতিই দায়ি। প্রশ্ন উঠেছে, চিনিকলগুলো বন্ধ না করে, একে কি লাভজনক করার কোনো উপায় নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, অবশ্যই উপায় আছে। তার জন্য সবার আগে মাথাভারি প্রশাসন ছেঁটে ফেলতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করে জবাবদিহীমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে। কারখানার পুরনো যন্ত্রপাতি বাদ দিয়ে উন্নত প্রযুক্তির আধুনিক মেশিন বসিয়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে। চিনিকলগুলোর আধুনিকায়ন, ডিস্টিলারি ইউনিট স্থাপন, জৈব সার উৎপাদন, মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট, জুস প্লান্ট স্থাপনসহ নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তারা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশের চিনি আমদানি কমাতে যে পরিমাণ চিনি প্রয়োজন তা উৎপাদন করলেও চিনিকলগুলোকে লোকসান গুণতে হয় না। কিন্তু সেদিকে কেউ এগোয় না। কেন এগোয় না-প্রশ্ন সেখানেই।
বাংলাদেশ লোকসান গুনছে। অথচ জাপান ও থাইল্যা- নাকি এই চিনিকলগুলোতে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চান। তারা এরকম একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে এত টাকা কেন বিনিয়োগ করবে? নিশ্চয় লাভের আশায়। তারা পারলে আমরা পারব না কেন! বিষয়টির উত্তর অনেক গভীরে। সেই গভীরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মুক্তবাজার অর্থনীতির খেলা। লুকিয়ে আছে নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির চক্রান্ত। চিনিকল শ্রমিক ও আখচাষী আন্দোলনের নেতারা বলছেন, সকল চক্রান্ত রুখে আমরা চিনিকল, শ্রমিক ও আখচাষীদের রক্ষা করব। রাজপথের লড়াইয়েই তার ফায়সালা হবে।