রবিবার,৫,মে,২০২৪
32 C
Dhaka
রবিবার, মে ৫, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়২৫ মার্চ: জাতীয় গণহত্যা দিবস

২৫ মার্চ: জাতীয় গণহত্যা দিবস

৫০ বছরেও অধরা

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

।। মুক্তার হোসেন নাহিদ ।।

“পদ্মা অববাহিকার আকাশ ছেয়ে গেছে শকুনে শকুনে। ইতোমধ্যে আড়াই লাখ মানুষের লাশ তারা পেয়েছে খাদ্য হিসেবে।”-’৭১ এ গণহত্যা নিয়ে রিপোর্ট করেছিল বার্তা সংস্থা এপি’র সংবাদাতা। অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী কেবল ২৫ মার্চ রাতেই ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। আর আমেরিকার লাইফ পত্রিকার রিপোর্ট-‘শকুনরা এসব মৃতদেহ এত খেয়েছে যে তাদের অরুচি ধরে গেছে।’ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে ৩০ লক্ষ মানুষ পাকিস্তানিদের নির্মম গণহত্যার শিকার হন। আজ ২৫ মার্চ: জাতীয় গণহত্যা দিবস। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। ৫০ বছরেও ’৭১-এর নির্মম গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে নি। ৪৬ বছর পর গণহত্যার জাতীয় দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এসেছে ২০১৭ সালে। আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির সময় পার হয়ে গেছে আরো আগেই। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর তার স্বীকৃতি নিয়েছে আর্মেনিয়া। ফলে আমাদের এখন জোর দিতে হবে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে। কিন্তু তার জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার তা চলছে ঢিলেতালে।
রাও ফলমান আলী তার ডায়েরিতে লিখেছিল-‘বাংলার সবুজকে লাল করে দিতে হবে।’ টিক্কা খানের ঘোষণা ছিল-“আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না।” সত্যি রাও ফরমান, নিয়াজি, টিক্কা খানরা এদেশীয় রাজাকার-আলবদর-আল সামসদের নিয়ে বাংলার জমিনকে রক্তে লাল করেছিল। মেতে উঠেছিল হত্যা ও নির্যাতনের হোলি খেলায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হলকাস্টে ৫ বছরে ৬ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়। কিন্তু মাত্র ৯ মাসে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। যা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন নৃশংসতম ও বর্বরোচিত হত্যাকা-। ’৭১-এর ২৫ মার্চ আগুন জ্বলেছিল পলাশির বস্তিতে। বিদ্রোহ হয় পিলখানার তৎকালীন ইপিআর সদরদপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। দাউ দাউ করে জ্বলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, জগন্নাথ হল, শিক্ষকদের আবাসিক বাসভবনে চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ঘুমন্ত ঢাকায় রাতের শেষ প্রহরে কামানের গর্জন। পুরো ঢাকা নগরী পরিণত হয় লাশ আর রক্তের নগরীতে। কেবল ঢাকা নয়, ওরা সেই রাতে ঢাকার বাইরেও বড় বড় শহরে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে। সেদিন থেকে ওই বছরের ডিসেম্বরে বিজয়ের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানিদের হাতে গণহত্যার শিকার হন ৩০ লাখ বাঙালি। খুলনার চুকনগরেই ওরা ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শিশু সন্তান মায়ের কোলে স্তনে মুখ, সে জানেই না তার মা আর নেই। স্বামী গুলি খেয়ে মৃত্যুর পরেও পরম আদরে আগলে আছেন প্রিয়তম স্ত্রীকে, বাবা-মা তার সন্তানকে। কি নির্মম, কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। এ দৃশ্য কেবল ঢাকা কিংবা চুকনগর নয়, এমন গণহত্যার শিকার হয়েছেন সারাদেশের মানুষ। বাংলাদেশে কী পরিমাণ বদ্ধভূমি, গণকবর আছে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কেন্দ্র ৬৪ জেলায় গণহত্যার জরিপ করছে। এখন পর্যন্ত ৩২ জেলায় জরিপ গ্রন্থ অনুযায়ী ১১৭৫৬টি গণহত্যার স্থানের সন্ধান মিলেছে। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং’ চিহ্নিত করেছে ৯৪২ টি গণকবর। ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ বই অনুসারে গণকবর সংখ্যা ৯০৫।
১৯৭১ সালের গণহত্যা নিয়ে বিশ্ব মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গষেকগণ বহু তথ্য তুলে ধরেছেন। লন্ডন টেলিগ্রাফে সে সময় গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছিলেন সাইমন ড্রিং। আর লন্ডন টাইমসে ‘ট্র্যাংস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রতিবেদন লিখেছিলেন লুই হেরেস। সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল ‘লন্ডন সানডে’তে। এছাড়া বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশের গণহত্যার খবর প্রকাশ করেছিল সিডনি শ্যানবাগ, ওরিয়ানা, ফেলাচি, বার্নার্ড হেনরি’সহ অনেকে।
১৯৮২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার জরিপের প্রতিবেদন-‘৯মাসে প্রতিদিন গড়ে ৬০০০ থেকে ১২০০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছে।’ গিনেসবুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এ বাংলাদেশের গণহত্যাকে বিংশ শতাব্দীর ৫টি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে। ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে ভুল করে ‘থ্রি লাখের স্থলে থ্রি মিলিয়ন’ বলেছিলেন-এমন বিতর্কও কেউ কেউ তুলেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলা বঙ্গবন্ধু ‘থ্রি মিলিয়ন’ ভুল করে উচ্চারণ করেন নি। এই ৩০ লাখ শহীদের তথ্যও আজগুবি আসে নাই। তার মুক্তির আগেই বিশ্ব মিডিয়ায় ৩০ লাখ শহীদের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাছাড়া ১৯৭২ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ’ই উচ্চারণ করে। গণহত্যা গবেষক লিও কুপার তার বিখ্যাত ‘জেনোসাইড’ বই তে উল্লেখ করেছে ৩০ লাখ। এনসাইক্লোপিডিয়া অ্যামেরিকানা ২০০৩ সালের সংস্করণেও ৩০ লাখ উচ্চারণ করেছেন।
এছাড়া ’৭১-এ পাকিস্তানিরা ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে বাঙালি নিধনযজ্ঞে নামে। তারা বাঙালিকে নিচু জাত মনে করত। জেনারেল নিয়াজির ভাষায়- ‘নিচু ভূমির নিচু জাতের মানুষ।’ অফিসারদের সাথে মিটিংয়ে নিয়াজি বাঙালিকে ‘ইঁদুর’ ও ‘বিড়াল’ বলে অভিহিত করত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরোধ লড়াই তারা মেনে নিতে পারে নি। তাই এদেশকে মেধা, রাজনৈতিক নেতা শূন্য করতে এবং জাতি হিসেবে বাঙালিকে ধ্বংস করতে নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। ওদের টার্গেট ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও এলিট শ্রেণি, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, লেখক, সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ মানুষ। ওরা বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যার জন্য উচ্চারণ করত “উড়া দে, জ্বালা দো, তাবা তাবা কারদো”। সে কারণেই তারা গণহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়।
এই নির্মম গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজো মেলে নি। দীর্ঘ ৪৬ বছর পর ২০১৭ সালে জাসদ নেতা সাংসদ শিরীন আক্তারের প্রস্তাবনায় সংসদে ২৫ মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয় এবং তা পরে মন্ত্রী পরিষদ সভায় গৃহিত হয়। জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন হচ্ছে ৪ বছর ধরে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সুযোগ হাত ছাড়া হয়েছে ২০১৫ সালে। কারণ ওই বছরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আর্মেনিয়ানার প্রস্তাবনায় ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। যাতে বাংলাদেশও সম্মতি দিয়েছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহবায়ক শাহারিয়ার কবির ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাবে তা হয় নি। এখন সুযোগ আছে কেবল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। মুক্তিযুদ্ধ বিশ্লেষকরা বলছেন, তার জন্য প্রথম ধাপে বিভিন্ন দেশের সংসদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাশ করাতে হবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এ ধাপ পার করতে পারে নি বাংলাদেশ। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা ও সিয়েরা লিওনের মতো ছোট দেশ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশ পায় নি। ফলে এখন থেকেই জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রবল প্রতাপশালী চিলির জেনারেল পিনোশে সিনেট থেকে আইন পাশ করিয়েছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। কিন্তু অবসর জীবনে চিকিৎসার উদ্যেশ্যে স্পেনে গেলে সেখানকার আদালতে হিস্পানি তরুণকে অপহরণ ও গুম করার অভিযোগে মামলা হলে পালিয়ে লন্ডন যান। সেখানকার আদালতেও তাড়া খেয়ে দেশে এলে আন্তর্জাতিক চাপে চিলির আদালত শেষ পর্যন্ত তার বিচার শুরু করে। ফলে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে এই গণহত্যায় জড়িতরা আইনের আওতার বাইরে থাকলেও অপরাধ যেন সর্বদা তাদের তাড়া করে, চিহ্নিত করে নিষ্ঠুর ঘাতকরূপে-তার ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা।

সর্বশেষ