বান্দুং থেকে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গাইনাইজেসন:

বান্দুং থেকে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গাইনাইজেসন: মাও থেকে শি জিন পিং: যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও বাণিজ্যিক প্রভাববলয়কে কতটুকু চ্যালেন্জ দিতে পারবে এই সম্মেলনের ফলাফল- তা দেখার রইলো!/?

বান্দুং সম্মেলনের (১৯৫৫) সম্মেলনের পর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেসনের সম্মেলনের গুরুত্ব একটা নির্দিষ্ঠ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশগুলো ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের আহবানে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং এ এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় বিশটির মতো দেশ মিলিত হয়েছিল নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করার জন্য। সেই সম্মেলনের দশ দফার মধ্যে অন্যতম ছিল কোনো সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এরই ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকের দিকে গড়ে ওঠে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। মিসরের নাসের, ভারতের জওহরলাল নেহরু, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, বার্মার নে উইন প্রমূখ ছিলেন তার প্রবক্তা। তখন বৈশ্বিক রাজনীতিতে তথাকথিত শীতল যুদ্ধের যুগ। একদিকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নানা সাম্রাজ্যবাদী – পুঁজিবাদী সামরিক জোট। এর বিপরীতে এই দুই অক্ষ শক্তির বিপরীতে গড়ে উঠেছিল জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। ১৯৯০-৯১ এর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন হারিয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটা একক বিশ্ব শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠে।

বান্দুং সম্মেলন, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ইত্যাদিতে চীনের সমর্থন ও সংযুক্তি ছিল। তখন চীনে মাও সে তুংয়ের যুগ। মাওয়ের সাথে ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক বৈরী হয়ে পড়েছিল। মাও তখন উন্নত ও মাঝারি বিশ্বের বিপরীতে দরিদ্র দেশগুলোকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ও বিশ্ব শান্তি আন্দোলনে এশিয়ার চীন ও ভারতের সম্পৃক্ততা কার্যকর কোনো বৈশ্বিক জোট গড়ে উঠেনি কারণ এই দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ ও অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন।

কিন্তু ২০২৫ এসে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেসনের সম্মেলনে রাশিয়া, চীন ও ভারতের নেতৃত্বে যে কয়েকটি দেশের সমাবেশ ঘটেছে তার গুরুত্ব রয়েছে।

গত এক দশকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বেশ জোরালো ছিল। ভারত চীনের সাথে বৈরী হলেও রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যালেন্স করে বেশ এগিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে সব ওলট-পালট করে দিয়েছে। তাঁর শুল্ক যুদ্ধ ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র থেকে ঠেলে অসন্তোষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। চীন দক্ষতার সাথে ভারতকে কাছে টানার জন্য পরিবেশকে সহজ করেছে। ভারতও ট্রাম্পের একগুঁয়ে নীতির গুঁতায় আহত হয়ে সাংহাই সম্মেলনে যোগ দেয়। তবে এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, এই সম্মেলন জোটনিরপেক্ষ আদলে নয়। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক জোটের তুরস্ক ও পাকিস্তান অংশ নিয়েছে। পাকিস্তান চীনেরও দীর্ঘ সময়ের বন্ধু রাষ্ট্র। অন্য দিকে নেপাল, মালদ্বীপ অংশ নিয়েছে যারা ভারতও চীনের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করছে।

চীন বিশ্বরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় পুতিন ও ভারতকে দুই পাশে রেখে শি জিন পিং এমন একটা অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে যা যুক্তরাষ্ট্রের শিরঃপীড়ার কারণ হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নানা কার্যকলাপ বিশেষ করে শুল্কযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও সমালোচিত হচ্ছে। কারণ এখন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা বিভক্ত হয়ে পড়ছে।

চীন,ভারত ও রাশিয়ার জনসংখ্যা ও অর্থনীতির আকার বৈশ্বিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও ভারতের সম্পর্ক সহযোগিতামূলক হলে সবচেয়ে লাভবান হবে উপমহাদেশ। ভারতের সাথে তার প্রতিবেশীদের টানাপোড়েনের বড় একটা কারণ চীন বিকল্প হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য আছে। আবার চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভারতের জন্য কাঁটা। নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার রাজনীতি একবার ভারতমুখী আবার অন্যবার চীনমুখী হয়ে থিতু হচ্ছে। পাকিস্তানের রাজনীতি ভারতের প্রতি চিরবৈরী। চীন ও মার্কিনমুখী।

এই রাজনীতির বড় শিকার বাংলাদেশও।

সাংহাই কোঅপারেশন চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করবে বিশ্বরাজনীতিতে – এত সহজেই তা বলা যাবে না। তবে চীন তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সহযোগিতামূলক চাল দিয়ে ব্রিকস ও সাংহাই কোঅপারেশনকে এগিয়ে নিলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোটকে কতটুকু চ্যালেন্জ করতে পারবে – জানি না, তবে ডলারের একক রাজত্বের মাজা ভেঙে দিবে – এটা নিশ্চিত। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে যে অনেক ছাড় দিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি করতে হয় চীন মাওয়ের আমল থেকে শি জিন পিং এর আমল পর্যন্ত দেখালো। ভবিষ্যতে দেখা যাবে এর থেকে চীন কতটুকু আর অন্যান্য দেশ কতটুকু ফল লাভ করবে।

লেখক-

শরীফ শামশির

লেখক ও গবেষক