পোস্ট- আমেরিকার ধারণা, ক্যারিবিয়ান সাগরে মার্কিন রণতরী ও ট্রাম্পের এশিয়া সফর শুরু : নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো নয়তো!
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া প্রায় কয়েক বছর ধরে একটা ধারণাকে তাত্ত্বিক রুপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁর এই বিষয়ে একটা সুলিখিত পুস্তকও আছে। তাঁর মতে, গত এক দশকে পৃথিবী পোস্ট-আমেরিকান যুগে প্রবেশ করেছে। এর মূল কথা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোতে যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্য শুরু হয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর যে একক ক্ষমতাকেন্দ্র বিকশিত হয়েছে তা এখন ভাঙনের মুখে পড়েছে। সারা পৃথিবীতে কয়েক শত আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি, বিভিন্ন দেশের রেজিম চেইঞ্জ, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এবং বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ যুক্তরাষ্ট্রকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। সেখানে এখন ফাটল দেখা দিচ্ছে। প্রবহমান নদীতে যেমন ডুবোচর ধীরে ধীরে চরে পরিণত হয়ে নদীর প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে নদীর ক্ষমতা হ্রাস করে তেমনি বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোতে নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী জন্ম নিচ্ছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর মনে করা হয়েছিল রাশিয়া পশ্চিমের অংশ হবে কিন্তু দেখা গেলো রাশিয়ার সাথে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বৈরিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর ছদ্মবেশে একটা ছায়া যুদ্ধ চলছে। অন্যদিকে, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রসার যুক্তরাষ্ট্রের চোখের মনি থেকে চোখের কাঁটায় পরিণত হচ্ছে। ট্রাম্পের গত এক বছরের শুল্ক যুদ্ধের দিকে গভীর নজর দিলে তা স্পষ্ট হয়। এরপর, ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার উত্থান ও অর্থনৈতিক বন্ধন তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে নিয়ে আসছে। প্রথাগত জি-৭ এর বিপরীতে চীন, ভারত ও রাশিয়ার সমন্বয়ে অনেক গুলো অর্থনৈতিক জোট চরের মতো জেগে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র এখানেও বিপদ দেখছে। চীনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের কাছে সস্তা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিলিয়নারদের চোখের শূল। অর্থাৎ পণ্যের বাজার এবং উৎপাদন কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে – সেই যুদ্ধই ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ। এটাই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধ।
এটার একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে বর্তমান ট্রাম্পশাসিত বিশ্বের দিকে তাকালে। গত কয়েক মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইজরায়েলের গাজা গণহত্যাকে সমর্থন করে ইরান ও কাতারে বোমা ফেললো। আবার শান্তির দূত হয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ থামালো, ক্যারিবীয় সাগরে কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলায় নৌযুদ্ধ শুরু করেছে, এখন এশিয়া সফর শুরু করেছে। এশিয়া সফরের আগে ট্রাম্প বলেছেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি এশিয়া সফরে কথা বলবেন না। কানাডার উপর শুল্ক আরও বাড়ালেন। একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব। যুক্তরাষ্ট্রের সেরা নৌযান ক্যারিবীয় সাগরে মাদক পাচারের অভিযোগে ভেনিজুয়েলা ও কলম্বিয়ার নিরীহ জেলেদের মেরে ফেলছেন। বৈপরীত্য হলো, এশিয়া সফরের শুরুতে কাতারে শান্তির বাণী তিনি পরিবেশন করলেন। মালয়েশিয়ায় থাই কম্বোডিয়ার শান্তি চুক্তির অবতার হয়েছেন। খেলা এখন মাত্র শুরু। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া বাকি আছে। জাপানের নতুন নারী প্রধানমন্ত্রীর পরীক্ষা নেবেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় পরীক্ষা দেবেন। এখানেই তিনি চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকের বিষয়ে আশাবাদী।
এশিয়া সফরে ট্রাম্প কিন্তু শান্তির আড়ালে তাঁর দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি ও চীনের সঙ্গে একটা সম্মানজনক শুল্ক সমন্বয় আশা করছেন। কারণ চীনের সাথে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার আধিপত্য বজায় থাকলেও তাঁর দেশের অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের পণ্য ব্যতীত ভোক্তাদের কম পয়সায় পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না। এটা মুদ্রাস্ফীতি থেকে শুরু করে নানান প্রভাব ফেলবে। অর্থনীতিতে মন্দা এসে হানা দিবে। তখন জন-অসন্তোষেরই বিস্তার ঘটবে। সার্বিকভাবে তাই উপরের দিকে তাকালে ট্রাম্পকে অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও চীন, ভারত, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পা কাটছে।
যুক্তরাষ্ট্র আর অপ্রতিরোধ্য নয়; বিশ্বে নতুন নতুন শক্তির আর্বিভাব হচ্ছে। পোস্ট- আমেরিকান বিশ্বের আভাস দেখা দিচ্ছে যা প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক মনে হলেও মূলত তা বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন। ট্রাম্পের এশিয়া সফর শেষ হলে এই বিষয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করা যাবে। আপাতত নতুন সম্ভাবনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ মানে চীনসহ উদীয়মান বিশ্বকে সামরিক ভাবে মোকাবিলার যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়!
লেখক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক



