গতকাল রোববার ২১শে মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক বর্ণবাদ (রেসিজম) নির্মূল দিবস। শারীরিক বৈশিষ্ট্য যা প্রকাশ্যে দেখা যায়, যেমন শরীরের রঙ, চুলের ধরন, কিংবা চোখের গঠনের উপর ভিত্তি করে যে বৈষম্য ও সহিংসতা, সেটাই বর্ণবাদ। মনে করা হয়, ইউরোপীয়, আফ্রিকান বা চাইনিজ মানুষেরা ভিন্ন রেসের। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের যে বাহ্যিক পার্থক্য, রঙ কিংবা গঠনের, এই ভিন্নতা কি জেনেটিক? বিংশ শতকের শেষের দিকে, বায়জেনেটিক গবেষণা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করেছে যে, মানুষ (হোমোসেপিয়েন্স) প্রজাতিটিকে এই ভাবে বিভাজন করার কোন জেনেটিক ভিত্তি নেই। একজন ইউরোপীয় সাদা মানুষের সাথে আরেকজন ইউরোপীয় সাদা মানুষের যে পার্থক্য, একজন কালো মানুষের সাথে সেই মাত্রার পার্থক্য নাও থাকতে পারে। ফলে, জীববিজ্ঞানীরা “রেস” ধারনাটির কোন শারীরিক ভিত্তি নেই বলে একমত। তাহলে রেস বা বর্ণবাদী ধারনাটি আসলো কিভাবে? বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য, যেমন গায়ের, চোখের বা চুলের রঙয়ের ভিন্নতার কারণে, মানুষকে কেন বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হতে হয়? কেন গায়ের রঙ এর ভিন্নতার জন্য আমেরিকায় ও ইউরোপে বর্ণবাদী ঘৃণা, বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হতে হয়? কেন ভারতীয় উপমহাদেশে গায়ের রঙ এর জন্য মেয়েদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে? কারণ রাজনীতি। উপনিবেশিকতা, কারণ ক্ষমতা। কারণ শোষণ। কারণ দাস প্রথা ও জাত পাতের বৈষম্য। এই সময়ে আরেকটি কারণ ব্যবসা, এই উপমহাদেশে “ফেয়ার এন্ড লাভলি” প্রোডাক্টের। বর্ণবাদ শুনলে মনে হয় এটি কেবল সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের। বর্ণবাদের আরেকটি দিক আছে। বিপরীত বর্ণবাদ। সাদাদের ঘৃণা, কারণ তাঁরা ইউরোপীয় বা আমেরিকান। উপনিবেশের ইতিহাস আছে, এমন দেশের লোকেরা হয় বিপরীত বর্ণবাদী। এরা উপনিবেশ বা সাম্রাজ্যবাদের রাজনীতির বিরোধিতা না করে, “পশ্চিমের” বা “সাদাদের” ঘৃণা করে। ইউরোপীয় মেয়েদের পোশাক নিয়ে অশ্লীল মস্করা করে। বাংলাদেশে ও ভারতে আমি এরকম বিপরীত বর্ণবাদী অনেক পেয়েছি। শ্রেণি বৈষম্য, নারী-পুরুষের পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্য, নৃতাত্ত্বিক ভাষাগোষ্ঠী ও ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য, মুক্তমনা বা নাস্তিকদের প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতার সাথে দুনিয়াব্যাপী বর্ণবৈষম্য ও সহিংসতা একটি বিশেষ সমস্যা আছে। অনেক গণহত্যা ও অভিবাসনের একটি কারণ বর্ণবৈষম্যের সংস্কৃতি ও মতাদর্শ। জার্মান গ্রীনপার্টির দুইজন নেতা “রেস” শব্দটাই সংবিধান থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব এনেছেন, কারণ “রেস” বলে বাস্তবে কিছু নেই। শব্দ বা ভাষার যে রাজনীতি আছে, তা আমরা সবাই জানি। পাকিস্তানীরা বাংলা শব্দ “হিন্দুয়ানী” নাম দিয়ে বাদ দিতে চেয়েছে এবং আরবি উর্দু শব্দের আমদানি করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের মৌলবাদী ফ্যাসিস্ট রাজনীতি পাকিস্তানী পন্থার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, এবং ভাষার সাম্প্রদায়িকিকরনে কিছুটা সফলও। জার্মানিতে গ্রীনপার্টির নেতারা সে কারণে সংবিধান সংস্কারের কথা বলেন। কিন্তু একটি শব্দ বাদ দিলেই কি বর্ণবাদী রাজনীতি বন্ধ হবে? আমার মনে হয়, হবে না। রেস বা বর্ণবাদ প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসতে হবে। সকল ধরনের বৈষম্য ও সহিংসতা নিয়েই আলোচনা দরকার। সভ্যতার বিকাশের জন্য, জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা ও প্রকাশের কোন বিকল্প নেই। তাই, বৈষম্য ও সহিংস কোন প্রসঙ্গই ধাপাচাপা দেয়া, অস্বীকার করা বা চুপ করিয়ে দেয়া, প্রগতির বিপক্ষে। ডিজটাল নিরাপত্তা আইন করে, চাপাতি দিয়ে খুন করে, ধর্মসন্ত্রাস করে, অথবা সামাজিক মাধ্যমে হুমকি দিয়ে, কথা বলার অধিকার কেড়ে নেয়া যায় না, শুধু সহিংসতা বাড়ানো যায়। বর্ণবাদ সহ সকল বৈষম্য ও সহিংসতার বিলোপ ঘটুক।
লেখকঃ খান আসাদ