Saturday,7,December,2024
21 C
Dhaka
Saturday, December 7, 2024
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়আমরা কি আরেকটি তালেবনী অভ্যুত্থানের অপেক্ষা করছি!

আমরা কি আরেকটি তালেবনী অভ্যুত্থানের অপেক্ষা করছি!

॥ রাশেদ খান মেনন ॥

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিবশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ২৬ মার্চ থেকে সংঘটিত ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে নারকীয় তা-ব হয়েছে তা অনেকের কাছে অভাবনীয় মনে হলেও মোটেই অদৃষ্টপূর্ব নয়। এর আগেও ১৯৯৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব উপলক্ষে ইমাম ও আলেমদের ডাকা হরতালে ঐ উৎসব উপলক্ষে এনজিও সংগঠন প্রশিকার তৃণমূল সংগঠনের সারাদেশ থেকে আসা নারী-পুরুষদের উপর হামলা হয়েছিলো তো বটেই তবে যে বিষয়ে ঐ ইমাম ও মাদ্রাসার ছাত্ররা বিশেষ উৎসাহী ছিল তা’হল নারীদের লাঞ্ছনা করা, তাদের বিব্রস্ত্র করা, এমনকি শারিরীকভাবে নির্যাতন করা। এবারের মত সেবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রশাসন ঐ হরতালের দিন শহর থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এবার অবশ্য পুলিশ আর-বর্ডার গার্ড মোতায়েন ছিল। কিন্তু আগের দিন শহর ও শহরতলীর তিনটি অংশে সংঘর্ষে ৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় তারা পিছিয়ে গিয়েছিল কিনা বলতে পারছি না। এ কারণেই সম্ভবতঃ স্থানীয় সংসদ সদস্য ওবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন করে ঐ হরতালে নেতৃত্বদানকারী জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা আক্রমণের অভিযোগ তুলেছে, যা স্থানীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্য অনুযায়ী সবৈব মিথ্যা। এবারও প্রশাসন ১৯৯৮ সালে যেভাবে প্রশিকার কাজী ফারুকের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ এনেছিল। এবারে প্রশাসন সে কথা না বললেও আইজিপি সদলবলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাবলী পরিদর্শন করে লম্বা-চওড়া এক সাংবাদিক সম্মেলন করলেও স্থানীয় সংসদ সদস্যের সাথে কোন আলোচনা করেছেন কিনা উল্লেখ করেন নাই অথবা এ ধরনের কোন সংবাদও প্রকাশিত হয়নি। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফাজত স্থানীয় সংসদ সদস্যকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র বা জেলার তরফ তার কোন প্রতিবাদ বা প্রতিবিধানের ব্যবস্থা হয়েছে কিনা তাও জানা যায় না।
শুরুতেই যে কথা বলেছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাবলী অদৃষ্টপূর্ব নয়, বরং ১৯৯৮ সালে যে ঘটনাবলী ঘটেছিল তারই পুনরাবৃত্তি এবং বৃহত্তর পরিসরে। সে সময় ঐ ঘটনাবলী সম্পর্কে তদন্ত কমিটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মানবাধিকার কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিল তা ঢাকায় জাতীয় প্রেসকাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করায় পরদিনই ঐ তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট আকসির এম চৌধুরীকে (যিনি সে সময় জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য) ফাঁসির দ- দেয় ঐ ইমাম ও ওলামারা। তাঁরা শহরের বাঁসা আক্রমণ করলে, বৃদ্ধা মা, বোবা স্ত্রী ও শিশু কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে জীবন বাঁচান। কিন্তু দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে সে সময়ে ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে কোন নিরাপত্তা দেয় নাই। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংগঠন এর প্রতিবাদ করে নাই। বরং ১৯৯৮-এর ডিসেম্বরের ঐ ঘটনাবলীর কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন আইন মন্ত্রী সদ্য প্রয়াত সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু এমপি মাদ্রাসা ইউনুসিয়ায় ‘বড় হুজুর’ শতোর্ধ মওলানা সিরাজুল ইসলামের সাথে দেখা করে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তার পরিণতি ফল আমরা দেখেছিলাম যে পরের বৎসর সেপ্টেম্বরে। ইসলামী ঐক্য জোট নেতা মওলানা ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে দেশে সকল এনজিও কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান হয় এবং ঘোষণা দেয়া হয় যে তা না’হলে সারাদেশে হরতাল পালন করে এনজিও অফিসগুলো দখল করে মত্তব ও মাদ্রাসায় রূপান্তরিত করা হবে। মওলানা ফজলুল হক আমিনী বর্তমানে বেঁচে নাই, তবে তার জীবদ্দশায়ই দেখে গিয়েছিলেন ইউনুশিয়া মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণে আরও ৫০-৬০টি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবারের হরতালে ঐ একইভাবে ইউনুসিয়া মাদ্রাসায়ই নেতৃত্বে কয়েকশ’ ছাত্র-শিক্ষক তিনদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলে রেখেছিল এবং ১৯৯৮ সালে যেমন ‘বিজয় উৎসবের আয়োজনকারী প্রশিকা অফিসসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল এনজিও অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তাদের প্রতিষ্ঠিত পাঠাগার, শিশুদের জন্য স্কুল, নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ধ্বংস সাধন করেছিল, এবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারি স্থাপনাসমূহ, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, পৌর মিলনায়তন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সঙ্গীতায়ন, গণগ্রন্থাগার, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অঙ্গণে, স্বাধীনতা উৎসবের স্থাপনাগুলো আর বিশেষ করে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, যা একদিকে যেমন একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দেয়, তেমনি মনে করিয়ে পচাত্তরের পনেরই আগস্টে খুনীতে গুলীতে জর্জরিত বঙ্গবন্ধুর লাশের চিত্র।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রতিক তিনদিনের ঘটনাবলীর সাথে ১৯৯৮-এর দিনগুলো, সময়কাল ও অভ্যুত্থানের সাযুজ্য শনাক্ত করতে খুব পর্যবেক্ষণ শক্তির প্রয়োজন হয় না। ১৯৯৮-তে আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ‘বিজয় উৎসব’ আর আক্রমণের অজুহাত ছিল নারী-পুরুষের একত্র সমাবেশ ও এনজিওদের ধর্মবিরোধী তৎপরতা। এবারের ঘটনার শুরু হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের দিন, অজুহাত মোদীর আগমন, অভিযোগ মোদীর মুসলিমবিরোধী পদক্ষেপ। সে সময় যেমন আক্রমণকারীদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় উৎসব, এবারও ঘটনার শুরু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দিয়ে। এর আগে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে’ ১৭ মার্চ তার জন্মদিনের দু’দিন আগে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সংখ্যালঘু গ্রামে আক্রমণ করা হয়। এখানেও আক্রমণকারীদের স্লোগান ছিল, ‘হেফাজতের এ্যাকশন, ডাইরেক এ্যাকশন,’ ‘মামুনুল হকের এ্যাকশন, ডাইরেক এ্যাকশন’। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে কোন ভুল হয় নাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের স্মারকসমূহসহ আনন্দ মানের মন্দিরও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জঙ্গি ইসলামী খেলাফত আইএস-এর আক্ষরিক পরাজয় ঘটলেও তাদের মানসিক পরাজয় ঘটেনি। বিভিন্ন দেশেই তারা নতুনভাবে পুনর্গঠিত হবার চেষ্টা করছে। আফগানিস্তানের তালেবানরা আরও বহুধাপ এগিয়ে সেখানে ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করা শান্তিচুক্তি অনুসারে সেপ্টেম্বরে মার্কিনী সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা হলে তারা সত্বরই কাবুল দখল করে নেবে বলে এমনকি আফগানিস্থানের বর্তমান প্রশাসকরা সে রকমই ধারণা করে। সুতরাং বাংলাদেশে আমিনীর তালেবানী বিপ্লবের স্লোগান আবার উচ্চরিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। তারই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে কওমী মাদ্রাসাগুলোতে হেফাজতের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার ভিত্তিতে ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকদের দিয়ে তান্ডব চালিয়ে। আর এ কারণেই কওমী মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের কোন প্রকার হস্তক্ষেপে তারা রাজী না। এমনকি এই কোভিডকালে সারাদেশে লকডাউন দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ, তখন কওমী মাদ্রাসা বন্ধ রাখার নির্দেশ তারা মানতে অস্বীকার করেছে। হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করে কওমী মাদ্রাসা ও হেফজখানাগুলো খুলে দেয়ার দাবি করেছে হেফাজতের আমীর বাবুনগরী। নইলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেবে বলে হুমকিও দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কওমী মাদ্রাসার সনদ দিয়ে হেফাজতকে সন্তুষ্ট রাখতে চেয়েছিলেন। তারা তাকে ‘কওমী জননী’ উপাধিও দিয়েছিল। এখন এটা বোঝার যে পরের পোলাকে নিজের পোলা করা যায় না। একটু সাবালক হলেই ঐ পালিতপুত্র জননীকে অস্বীকার করে নিজের শিকড়েই ফিরে যায়। আর এখানে তো কওমী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণে সামান্যতম ব্যবস্থা নেয়া যায় নি। সুতরাং তারা নিজেদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করবে সেটাই স্বাভাবিক।
আমরা কি বাংলাদেশে আরেকটি তালেবানী অভ্যুত্থানের জন্য অপেক্ষা করছি?
নোট : আফগানিস্তান ও পাকিস্তান অঞ্চলে মাদ্রাসা ছাত্রদের তালেবান বলা হয়।

১৫ এপ্রিল ২০২১

সর্বশেষ