নিতাই চন্দ্র রায়ঃব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকদের চাপের মুখে সরকার কেজি প্রতি ৫ টাকা বাড়িয়ে আলুর দাম পুননির্ধারণ করে। প্রতি কেজি আলু হিমাগার পর্যায়ে ২৭ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ৩০ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩৫ টাকায় বিক্রি দাম নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সরকারের বেঁেধ দেওয়া মূল্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোথাও আলু মিলছে না। সারা দেশের হাট-বাজারগুলোতে এখনো ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে আলু। পণ্যটির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে বড় বিপদে পড়েছে স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। এমনিতেই কাজ-কর্ম নেই। দোকানে বেচা-কেনা নেই। তারপর আলুসহ সকল সবজি ও মোটা চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে দম বন্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম-গঞ্জের গরিব অসহায় মানুষগুলোর।
গত ১৯ অক্টোবর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, দেশের ৩৯৩টি হিমাগারে এখনো ২৩ লাখ মেট্রিক টন আলু মজুদ রয়েছে। এরমধ্যে বীজ আলু আছে ১০ লাখ মেট্রিক টন। আগামী ডিসেম্বরে নতুন আলু বাজারে আসার কথা। কিন্তু বন্যা ও বিলম্বিত বর্ষার কারণে সেটি দেরি হতে পারে। ফলে ৬ লাখ মেট্রিক টন আলু ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। অপরদিকে দেশ থেকে যে পরিমাণ আলু রপ্তানি হয় তার পরিমাণ খুবই সামান্য। এ মৌসুমে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আলু রপ্তানি হয়েছে। এতে বাজার মূল্য প্রভাবিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কৃষকদের আলু উৎপাদন ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য আলু রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তাই রপ্তানি বন্ধের আগে কৃষকদের স্বার্থের কথাটি বিবেচনা করতে হবে।হিমাগার পর্যায়ে আলুর সংকট থাকায় আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সবজিটি রপ্তানি বন্ধে সরকারের নির্দেশনা চেয়েছে কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়। আমাদের হিমাগারগুলির ধারণ ক্ষমতা হলো ৫০ লাখ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সময়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এবং লকডাউন ও পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থার কারণে হিমাগারগুলি তাদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী আলু সংরক্ষণ করতে পারে নি। এ খবরটি যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখনই আচ করতে পেরেছিলাম-সামনে আলু নিয়ে দেশে সংকট শুরু হতে পারে এবং সুযোগ নিতে পারেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। কে জানে এবছর বর্ষা এত দীর্ঘায়ীত হবে?তিন তিন বার বন্যায় কৃষকের সবজি ক্ষেত ও সবজির চারা বিনষ্ট হবে? কে জানতো করোনা সংক্রমণের কারণে কৃষকের জমিতে সবজি পচে বিনষ্ট হবে? কৃষক সর্বস্বান্ত হবে? অর্থের অভাবে অসহায় কৃষক সময় মতো খরিপ-২ মৌসুমের সবজি রোপণ ও যতœ নিতে পারবেন না? বাজারে এখন প্রতিটি সবজির দাম নিচে ৫০ থেকে উপরে ৮০ টাকা। সবজির দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে আলুর দাম বেড়ে হয়েছে প্রতি কেজি ৫০ টাকা। স্বাভাবিক অবস্থায় এ সময় আলুর দাম থাকে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি। বাংলাদেশে সবজি আর আলু যেন জমজ সন্তান-একটির দাম বাড়লে অন্যটিরও দাম বেড়ে যায়। একটির দাম কমলে অন্যটিরটিরও দাম কমে যায়। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যে বছর আলুর দাম বেশি থাকে, সে বছর কৃষক বীজের অভাবে লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক আলু রোপণ করতে পারেন না। ফলে পরের বছর আলু উৎপাদন ব্যাহত হয়। হিমাগারগুলি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আলু পায় না এবং পণ্যটির দাম থাকে আকাশচুম্বী।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন কর্তৃক আলু বীজের দাম প্রকার ভেদে গত বছরের চেয়ে ২১ থেকে ২২ টাকা বৃদ্ধি করে ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা নির্ধারণ করায় প্রান্তিক কৃষক ও বীজ ডিলারদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের কথা বিএডিসি কর্তৃক বীজের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষক কম দামের নি¤œ মানের বীজ রোপণ করবেন। এতে আলুর ফলন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। আমার সন্দেহ হচ্ছে-এবার অনেক কৃষক বীজের অভাবে ধান কাটার পর আলু রোপণ করতে পারবেন না। এক বিঘা জমিতে আলু রোপণ করতে হলে কমপক্ষে ৩৩০ কেজি আলু বীজের প্রয়োজন। প্রতিকেজি বীজআলুর দাম ৩৫ টাকা হলেও বীজ ক্রয়ে কৃষককে ১১ হাজার ৫৫০ টাকা খরচ করতে হবে। চাষাবাদ, সার ও অন্যান্য পরিচর্যা বাবদ আরও ৪ হাজার টাকা প্রয়োজন হলে এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে কৃষককে বিনিয়োগ করতে হবে কমপক্ষে ১৫ হাজার ৫৫০ টাকা। আর আলুর আবাদ না করে সরিষার চাষ করলে তার খরচ হবে ৮শ থেকে এক হাজার টাকা। তাই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে আলুর পরিবর্তে সরিষার মতো স্বল্পমেয়াদী ও কম খরচের ফসলের দিকে ঝুঁকবেন- এটাই স্বাভাবিক। ফলে আলু চাষে আগ্রহী কৃষককে ৪% সুদে অতি তাড়াতড়ি কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪% সুদে সরকার ঘোষিত কৃষি ঋণ প্রণোদনার এখনও ৫০ভাগ অর্থ কৃষকের মধ্যে বিতরণ করেনি দেশের বিধিবদ্ধ ব্যাংকগুলো। কৃষকের কষ্টের কথা তাদের কানে যাচ্ছে না। তারা নানা অজুহাতে কৃষকের এই মহাদুর্যোগকালে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করছেন না। নানা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে বিষয়টিকে হালকা ও ছেলে খেলার মতো মনে করছেন। এব্যাপারে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাÐও দেশবাসীকে চরম হতাশ করেছে। এখনও সময় আছে-দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার। সময় মতো ৪% সুদে কৃষি ঋণ বিতরণ করে কৃষকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার। আলুর আবাদ বাড়াতে হলে-আলু বীজ বিতরণে বিএডিসিকেও যথার্থ ভূমিকা পালন করতে হবে। দেখা গেছে, যে বছর বাজারে আলুর দাম বেশি থাকে, সে বছর সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে আলু বীজ বিক্রি করেন বিএডিসির ডিলারগণ। তারা বিএডিসি থেকে বীজ আলু উত্তোলন করে প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে বিক্রি না করে বেশি দামে ক্ষুদ্র বীজ ব্যবসায়ীদের কাছে কিক্রি করে বাজারে বীজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এতে আলু বীজ নিয়ে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয় কৃষকদের।তাই এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, উপপরিচালক কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও উপপরিচালক বাংলাদেশ কৃষিউন্নয়ন কর্পোরেশন( বীজ) কে নিয়মিত আলু বীজ বিক্রির কাজ তদারক ও মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৬ টা হতে পরের দিন সকাল ৯ টা পর্যন্ত রংপুরে একদিনে সর্বোচ্চ ৪৬৬ মিলিমিটার বৃষ্টি গত ১০০ বছরের রেকর্ডকে ¤øান করে দিয়েছে। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে বেশি পরিমাণে আগাম আলু উৎপাদন হয়। বৃষ্টির কারণে এবছর হয়তো সেটাও সম্ভব হবে না। আগাম আলু উৎপাদন এবার পিছিয়ে যেতে পারে । ১৩ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মৌসুমী বৃষ্টিপাত অব্যাহত ছিল। এই অবস্থায় আগাম আমন ধান কাটার সাথে সাথেই কৃষক গত বছরের মতো আলু রোপণ করতে পারবেন না। তাকে বৈরি আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু দিন। আমি নিজের চোখে দেখেছি, কৃষক অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি আমন ধান কেটে ওই জমিতে গ্রানুলা জাতের আলু রোপণ করে ৭০ দিনের মধ্যে ক্ষেত থেকে আগাম আলু তোলে ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাজারে নতুন আলু বিক্রি করেন। এ সময়ে বগুড়া অঞ্চলের কৃষকেরাও লাল পাকড়ি জাতের আলু উত্তোলন করেন।
এ বছর বীজ আলু সংকটের যতেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আলু বীজের সংকট সমাধানে বিদেশ থেকে অতিদ্রæত আলু বীজ আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে বিএডিসির মাধ্যমে স্বল্প দামে কৃষকদের মধ্যে সরবরাহের জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিনামূল্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের মধ্যে আলু বীজ বিতরণ করতে হবে।উত্তরাঞ্চলের কৃষক গত মৌসুমে প্রতিকেজি আলু বিক্রি করেন ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজিতে। ৬০ কেজি ওজনের এক বস্তা আলুর হিমাগার ভাড়া ২২০ টাকা এবং শতকরা ৫ ভাগ লাভ যোগ করলে হিমাগার পর্যায়ে প্রতিকেজি আলুর সর্বোচ্চ দাম হওয়া উচিত ১৯ টাকা ৬০ পয়সা। অথচ সরকার হিমাগার পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা। তারপরও হিমাগার মালিকেরা সরকার নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করছেন না।নানা রকম টালবাহানা করে আলুর বাজারকে অস্থির করে তুলেছেন। তাদের কথা-গত মৌসুমে আলু উৎপাদন কম হয়েছিল। হিমাগারগুলিতে মজুদ ছিল ৪০লাখ টন আলু, যার প্রায় ৬০ শতাংশ ইতিমধ্য তোলা হয়ে গেছে। বাজার গবেষকদের কথা আলুর দামের অর্ধেকেরও বেশি পাচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা প্রতিকেজি আলুতে লাভ করছেন ২০ থেকে ২৫ টাকা।এ সময়ে আলুর দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের কোনো লাভ হবে না। কারণ হিমাগারগুলিতে বিক্রির জন্য কৃষকের কোনো আলু নেই। লাভ হবে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকদের।এতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক আলু চাষিদের প্রচুর ক্ষতি হবে। কারণ, তাঁকে ২০ টাকা কেজির বীজআলু ৪৭ টাকা দামে কিনে রোপণ করতে হবে। তাই আলুর উৎপাদন বাড়ানোর সাথে সাথে কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণের সুযোগও বাড়াতে হবে।তা না হলে কৃষক আলু চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। থেমে যাবে আলু উৎপাদন অগ্রগতির ঘূর্ণমান চাকা।