।। শঙ্কর কুমার মল্লিক ।।
কবি শঙ্খ ঘোষ আজ চলে গেলেন। করোনার বলী আর এক নক্ষত্র। যিনি সারাজীবন আলো জ্বেলেছেন তাঁর লেখায়। কবিতায় এবং গদ্যে। নব্বই বছরের সফল জীবন তিনি যাপন করেছেন। অতিমারীর ছোঁবলে থেমে গেল জীবন। কবিদের মৃত্যু হয় না। তাঁরা বেঁচে থাকেন কবিতার পংক্তিতে। ভালোবাসায় শ্রদ্ধায়। কবিতার শব্দে জ্বেলে দেওয়া আলো পথ দেখায় আঁধার সময়। কবি শঙ্খ ঘোষ এরকম অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। মানুষের কথা, মানবতার কথা সেখানে উচ্চকিত। মানুষের জন্য তিনি কবিতা লিখেছেন। আবার মানুষের প্রয়োজনে তিনি লেখার টেবিল ছেড়ে রাজপথে দাঁড়িয়েছেন। সভ্যতার বিপর্যয়ে, মানবতার আকালে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের কালে প্রতিবাদ করেছেন কবিতায়। সে প্রতিবাদ ক্ষোভে এবং বিদ্রূপে যুগপৎ উচ্চারিত হয়েছে।
মাঝে মাঝে শুধু খসে পড়ে মাথা
কিছু-বা পুরনো কিছু -বা তরুণ
হাঁক দিয়ে বল কনডাকটর
পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন
সমাজের পিঠে এরকম বিদ্রূপের চাবুক মেরছেন সপাং সপাং। একটু পরখ করে দেখলে কালশিটে দাগ চোখে পড়ে। আবার তিনিই প্রথম কাব্যগ্রন্থ ” দিনগুলি রাতগুলি ” তে লিখেছিলেন, ” রাত্রির কলস ভেঙে দিন গড়িয়ে যায় ” – কতটা আশ্বাসের কথা, বিশ্বাসের কথা, সম্ভাবনার কথা, আলোকময় আগামীর কথা। কিন্তু সময়ের সাথে তিনিও গ্লানি, ক্লেদ, কর্দমাক্ত পথ অতিক্রম করেছেন। ” পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন ” বলে কবিতায় চাবুক মেরেছেন। ক্ষমতাদম্ভী শাসকের ভেতরের বাইরের চেহারা তুলে এনেছেন কবিতায়। অনায়াসে লিখেছেন, ” পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ “। আবার ” সবিনয় নিবেদন ” লিখেছেন
আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্য শাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা।
তাছাড়া তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা ” মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে ” তে অসার সময়ের কথা বলেছেন অনায়াসে। কর্পোরেট পুঁজি আর মুক্তবাজার অর্থনীতির নগ্ন দাপটে মুখ এবং মুখোশের পার্থক্য বোঝা দায়। প্রেম, ভালোবাসা, দ্রোহ, ঘৃণা সবই আজ পণ্য। বিজ্ঞাপনের ঝলসানো আলোয় প্রকৃত আলো অন্ধকার একাট্টা। তিনি লিখেছেন –
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
…তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
………………………………….
মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।
অতিমারীর এই গভীর সংকটকালে বিদায় নিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। কিন্তু সত্যিই কি বিদায় নিলেন ? নাকি মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আরও কাছে এলেন, নিবিড় হলেন ! মানুষের এই সংকটকালে আরও প্রাসঙ্গিক হলেন, প্রাসঙ্গিক থাকবেন। কারণ, এদেশের যমুনাবতীরা আজও বাসর রচনা করে বারুদ বুকে নিয়ে। সেই কবে লিখেছিলেন –
নিভন্ত এই চুল্লীতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে।
…………………….
যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে নিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে।
বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই মানুষের কবি, মানবতার কবি শঙ্খ ঘোষ।
লেখক : অধ্যাপক, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা