।। কামরূল আহসান ।।
২৭ মে,ভোর ৬টায় মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। ও প্রান্ত থেকে ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা ডাঃ কাশেম জানালেন দেলওয়ার ভাই আর নেই। অসুস্থ্য হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হলে গত ২৬ মে ২০২১ দিবাগত রাত ১২টায় মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যূর সংবাদে সকালেই ছুটে যাই গাজীপুরে শিমুলতলীর শান্তিবাগে তার বাসভনে।
অবয়বে খুবই সাধারণ এবং নিরীহ গোছের একজন ভদ্র, বিনয়ী ও স্বল্পভাষি মানুষটি চলনে বলনে ছিলেন সুশীল ও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। বাড়িতে লুঙ্গি গেঞ্জি পরলেও বাইরে সাধারণ মানের শার্ট চমৎকার ইন করে প্যান্ট পরা মানুষটি ছিলেন সদা হাস্যজ্জ্বোল। বাইরে বিনয়ী ও নিপাট ভদ্র এই মানুষটি অন্তরে ধারণ করতেন মানুষের মুক্তির দিশা, শোষন মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তাঁর আকাঙ্খা। আপাদমস্তক এক দৃঢ় চেতা বিপ্লবী ছিলেন, যিনি বিপ্লবী আদর্শকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সমুন্নত রেখেছিলেন।
বাংলাদশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রবীণ এই নেতা ছিলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গাজীপুর পার্টির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ কৃষিফার্ম শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য।
কমরেড মীর দেলওয়ার হোসেন ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার ভাওরপাঁচ গ্রামের মীর বাড়ীতে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করে গাজীপুরে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগদান করেন। চট্টগ্রামে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনষ্টিটিউটে প্রায় দুই বছর ট্রেনিং শেষে তিনি ১৯৬৯ সনের ১ জুলাই সিনিয়ার টেকনিসিয়ান গ্রেড-১ (মেকানিক্যাল ফিটার) হিসেবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরীর অ্যাসেম্বলি শপে যোগদান করেন।
এখানেই প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা মোতালেব হোসেন ও চৌধুরি গিয়াস উদ্দিনের সাথে সম্পর্কিত হন। প্রখ্যাত কমিউনিষ্ট ও শ্রমিক নেতা নাসিম আলীর সান্নিধ্যে এসে কমিউনিষ্ট আন্দোলনের হাতিয়ার গ্রুপে যোগ দেন। ৬৯-র এর গণ আন্দোলনে মেশিন ট্যুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকেরা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। কমরেড দেলওয়ার সেই আন্দোলনে ছিলেন একজন তরুন কর্মি। সেই সময়ে শ্রমিক নেতা মোতালেব হোসেন, চৌধুরি গিয়াস উদ্দিন, কে.এম লুৎফর রহমান, নজরুল ইসলাম খান, হারুন উর রশিদ প্রমুখরা ছিলেন মেশিন ট্যুলস ফ্যাক্টরির নেতা। তাদের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে গাজিপুরে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠে। ৭১ এর সেই উত্তাল দিনের এক পর্যায়ে কমরেড দেলওয়ারসহ মেশিন ট্যুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকেরা গাজীপুরের সমরাস্ত্র কারখানা ঘেরাও করে। তারা সেখানে উপস্থিত সেনা সদস্যদের আটকে রাখে।
১৯৭১ সালের ১৯ শে মার্চ গাজীপুর চৌরাস্তায় সেই প্রতিরোধের দিন জনতার সাথে মেশিন ট্যুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকেরা সক্রিয় অংশ নেয়। এই প্রতিরোধে মীর দেলওয়ার, চৌধুরি গিয়াস উদ্দিন, কে.এম লুৎফর রহমান, নজরুল ইসলাম খান, হারুন উর রশিদরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঐ প্রতিরোধ চলাকালে চৌধুরি গিয়াস উদ্দিন একজন পাকিস্তানি সেনাকে লাথি মারেন, পরে তাঁকে সেনারা ৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় এক অপারেশনের সময় আটক করে তাঁর উপর চরম নির্যাতন চালায়।
ঐ প্রতিরোধের পর কমরেড দেলওয়ারসহ আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী সকল কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহন করে চাকুরিচ্যূৎ করে ও গ্রেফতারের সমনজারী করে।
এই পরিস্থিতিতে কমরেড দেলোয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে পাড়ি জমান। তিনি ভারতের মনতলা ক্যাম্পে যোগ দিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ৩নং সেক্টরের কমান্ডার কর্ণেল শফিউল্লার নেতৃত্বাধীন সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর নুরুজ্জামানের অধিনে বহু ফিল্ড অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তার গ্রুপ কমান্ডারের মাধ্যমে ঢাকায় ২য় ইষ্টবেঙ্গল রেজিম্যান্টের নিকট অস্ত্র সমর্পণ করেন।
দেশের স্বাধীকার আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার কারণে পাকিস্তানী সামরিক সরকার কমরেড দেলওয়ারসহ তাঁর সতীর্থদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে চাকুরিচ্যূৎ করেছিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি কর্মে ফিরতে চাইলে স্বাধীন দেশের কর্তৃপক্ষ তাকে প্রথমে নিয়োগে বাধা দেয়। পরবর্তিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের প্রমানপত্র দেখিয়ে চাকুরি ফিরে পান।
২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনকারী কমরেড দেলওয়ারের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঠাঁই হয়নি। তবে শেষ প্রচেষ্টায় ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে তার মৃত্যূর পূর্ব মুহুর্তে তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
মেশিন টুলস ফ্যাক্টরীতে কর্মরত থাকাকালীন অবস্থায় তিনি ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হওয়ায় তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে ফিরে এসে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
তাঁর হাতের লেখা ছিল সুন্দর। আগে হাতে লেখা পোষ্টারের প্রচলন ছিল। তখন দলের অথবা ফেডারেশনের পোষ্টার তিনি নিজেই লিখতেন। এবং নিজে পোষ্টার লাগাতেন। মিছিলে শ্লোগান দিতে তার কোন ক্লান্তি ছিলনা। কেন্দ্র বা স্থানীয় কোন সভা, সমাবেশ, মিছিল তিনি সবার আগে উপস্থিত হতেন। নির্ধারিত সময়ে সভায় উপস্থিত হওয়াকে তিনি বিপ্লবী দায়িত্ব মনে করতেন।
কমরেড মীর দেলওয়ার হোসনে ছিলেন আদর্শবাদী ও নিবেদিত প্রাণ এক কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পার্টির ঐক্য প্রক্রিয়ায় হাতিয়ার গ্রুপ লেনিনবাদী কমিউনিষ্ট পার্টিতে যুক্ত হলে তিনি তার সদস্য হন। ১৯৭৯ সালে লেনিনবাদী কমিউনিষ্ট পাটির খুলনা কংগ্রেসে তিনি প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন। পরবর্তিতে লেনিনবাদী কমিউনিষ্ট পাটি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি নামে প্রকাশ্য পার্টি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে তিনি সেই পার্টির গাজীপুর জেলার সংগঠকের ভুমিকা পালন করেণ। ঐ সময়ে পার্টির পরামর্শে তিনি ও তৎকালীন পার্টির নেতা নুরুল আনোয়ার ‘বাংলাদেশ মেশিন ট্যুলস ফ্যাক্টরী শ্রমজীবী ইউনিয়ন’ গঠন করেন যার প্রতিষ্ঠাকালীণ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কমরেড দেলওয়ার। ১৯৮৫ সালে পার্টির বিভক্তিতে কমরেড দেলওয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির (নজরুল অংশ) কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য হিসাবে তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র শ্রমিক আন্দেলনকে বেছে নিয়েছিলেন। চৌধুরি গিয়াস উদ্দিনের হাত ধরেই কমরেড দেলওয়ারের শ্রমিক আন্দোলনে আসা। শ্রমিক নেতা কমরেড নাসিম আলীর একজন যোগ্য শিষ্য, পরবর্তিতে কমরেড অমল সেনের দীর্ঘ সান্নিধ্যে ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত্য তিনি জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
সত্তর ও আশির দশকে শ্রমিক আন্দোলনের অনেক দুর্দান্ত ঘটনার প্রত্যক্ষ অংশিদার তিনি। এরশাদ সামরিক শাসন আমলে যুমনা গ্রুপের মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল অত্যন্ত প্রভাবশালী তখন। তার একটি কারখানায় একজন শ্রমিক হত্যা হলে তা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্ঠা চলে। স্থানীয় মেয়র, কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সমঝোতা করে বাবুল বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালান। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গাজীপুরের শ্রমিক ফেডারেশন। ফলে নানা ধরনের হামলা মামলার শিকার হয়েছিলেন তারা। এমন কি হত্যা হুমকিও তৈরী হয়েছিল। আপোষ রফার জন্য বড় অংকের অর্থের প্রলোভনও দেয়া হয়েছিল। কমরেড দেলওয়ারসহ সেদিনের গাজীপুরের পার্টি ও ফেডারেশনের নেতৃত্বের দৃঢ়তায় যুমুনা গ্রুপের সকল চক্রান্ত ভেস্তে যায়। তারা সেদিন বাধ্য হয়েছিল নিহত শ্রমিকের ক্ষতিপুরণ দিতে।
৭৪ বছর বয়সের জীবনের অধিকারী কমরেড দেলওয়ার খুবই সাধারণ জীবনে অভ্যস্থ ছিলেন। নোয়াখালী থেকে এসে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন গাজীপুরে। সেদিনের বনবাদাড়ে ঘেরা তার কর্মক্ষেত্রের কাছেই এক টুকরো যায়গা কিনে সেখানেই মাটির তৈরী ঘরে সংসার পেতেছিলেন। আজ গাজীপুরে এক খণ্ড জমির মুল্য কোটি টাকা। অথচ ষাট/সত্তরের দশকে আজকের এই অবস্থা ছিলনা। সেদিন স্থানীয়দের অনেকেই পরিচয়ের সুবাদে অস্থানীয় কর্মজীবীদের কাছ থেকে ধার দেনা করতেন। কমরেড দেলওয়ারও বহু মানূষকে ধার দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। ধার শোধ দিতে না পারা অনেকেই তাদের সম্পত্তি তাঁকে লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কমরেড দেলওয়ার সে সকল প্রস্তাব বিনয়ের সাথে এড়িয়ে গেছেন।
বিপ্লবী চেতনায় নিজেকে যেমন সমৃদ্ধ করেছিলেন কমরেড দেলওয়ার তেমনি তার পারিপার্শিক অন্যদের এই ধারায় যুক্ত করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালাতেন। পরিবারের সদ্যদেরও মতাদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে আলোচনা করতেন। একজন বিপ্লবীর জীবনবোধ কেমন হওয়া উচিৎ, তার উদাহরণ ছিলেন কমরেড দেলওয়ার।
লেখক: কামরূল আহসান, পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।