১৭ অক্টোবর। ভারতীয় উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯২০ সালের এই ১৭ই অক্টোবরে উপমহাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন হয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে। এ বছর ভারতীয় উপমহাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূরণ করল। (১৯২০ থেকে ২০২০)-এই একশোতে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হতে হয়েছে। তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় মানবেন্দ্র রায়, অবনী মুখার্জি, ইভলিন ট্রেন্ট রায়, রোজা ফিটিনভ, মহম্মদ আলী, মহম্মদ সাফিক সিদ্দিকী এবং এম.পি.বি.টি আচার্যের হাত ধরে জন্ম নেওয়া কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম থেকে আজ অবধি বহু লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে বহু কমিউনিস্ট বিপ্লবীকে। শতবর্ষের এই মাহেন্দ্রক্ষণে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সেই ৭ জনসহ এই উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করে প্রয়াত হয়েছেন সকলকে সাপ্তাহিক নতুন কথা’র পক্ষ থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও রক্তিম অভিবাদন।
সোভিয়েত রাশিয়ার পতন এবং নানা কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বিভক্তি এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হলেও এখনো কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে যায় নি। কেবল এই উপমহাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রয়োজনীতা বাড়ছে। বৈশ্বিক মহাসঙ্কট করোনা মহামারি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পুঁজিবাদ মানবতার নয়, নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। এই দুঃসময়ে সারা দুনিয়ায় মানুষের পাশে ছিল চীন, কিউবাসহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। মৃত্যুভয়ে যখন পুঁজিবাদীরা নিজেদের বাঁচানোর আকুতিতে ব্যস্ত, তখন কমিউনিস্টরাই দুঃসময়ে মানবতার ফেরিওয়ালা হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
কেবল দুর্যোগে নয়, মানুষের মুক্তির প্রশ্নেও কমিউনিস্ট পার্টি’ই সবার আগে আওয়াজ তুলেছে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠার ১ বছর পরেই ১৯২১ সালে আহমেদাবাদে কমিউনিস্টরাই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলেন। ব্রিটিশবিরোধী সকল সংগ্রামে কমিউনিস্টরাই সবার আগে থেকেছেন। অবিভক্ত ভারতে বাঘা যতীন, সুভাষ বসু, অরবিন্দু ঘোষ, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনোদবিহারী, ইলামিত্র, অমলসেন, মণিসিংহ সহ বহু বাঙালি ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে অনন্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এ কথা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি বাঙালির স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন ১৯৫৭ তে কমিউনিস্টদের গোড়া সমর্থক মওলানা ভাসানী। ১৯৭০ এর ২২ ফেব্রæয়ারি এই কমিউনিস্ট দীক্ষায় দীক্ষিত মেনন-রনো-জাফরা’ই প্রথম পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকার পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে। ভারতের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলে রয়েছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক বিরাট অবদান।
পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির ফলে বিরাট সম্ভাবনার সামনে উপস্থিত হয়েছে মানব সভ্যতা। আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। মানুষেরও উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই ব্যবস্থায় মানব সভ্যতার একটা বিরাট অংশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সকল ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ছে। শোষণভিত্তিক এই সমাজে শোষকের হাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে সকল সুফল। ৯৫ ভাগ মানুষের সম্পদ লুটেপুটে খাচ্ছে ৫ ভাগ মানুষ। ফলে অভাব, বেকারত্ব, লুন্ঠন, শোষণ তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। নয়া উদারনীতির থাবায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সকলে এর থেকে পরিত্রাণ চান। আর পরিত্রাণের একমাত্র পথ সমাজতন্ত্র। খোদ পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাই এখন ফিরে যাচ্ছেন কার্ল মার্কসের বিখ্যাত ‘দ্যা দাস ক্যাপিটাল’ গবেষণায়। এক সময় যারা বলতেন সমাজতন্ত্র অলীক বস্তু, এখন তারাই বলছেন পূজিঁবাদ শেষ কথা নয়, মানুষের মুক্তির পথ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ। পৃথিবীর দেশে দেশে তাই আবার উড়ছে লাল ঝাÐা।
কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার এই শতবর্ষে প্রমাণ হচ্ছে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। আর সে লড়াই হবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। দ্বিধা-বিভক্তি ভুলে আবার সবাই ঐক্যের কাতারে দাঁড়াবে। আবার উড়বে লাল পতাকা। লড়াই হবে শোষণের বিরুদ্ধে, লড়াই হবে মানুষের জন্য। কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ পেরিয়ে নবযাত্রায় এটাই প্রত্যাশা।
লেখকঃএমএইচ নাহিদ