বেলাল বাঙলি \ এদেশে শ্রমিক আন্দোলনের পথিকৃত, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরযোদ্ধা, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদের পুরোধা কিংবদন্তী শ্রমিক নেতা আবুল বাশার। শ্রমিক অন্তঃপ্রাণ এই বর্ষীয়ান নেতার জন্ম ১৯৩৪ সালে। এদেশের শ্রমিক আন্দোলনে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে তিনি প্রকৃতির অমোঘ সত্যের ডাকে চলে যান ২০১০ সালে। গত ৭ নভেম্বর ছিল তার ১০ম মৃত্যুবাষির্কী।
সাপ্তাহিক নুতন কথা’র পক্ষ থেকে এই মহান বিপ্লবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও লাল সালাম।
শ্রমিকনেতা আবুল বাশার কেবল শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বই দেননি, তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধেও সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন। চীনপন্থী কমিউনিস্টরা কেউ কেউ যখন মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ বলে প্রত্যাখান
করেছিলেন, তখন আবুলবাশার সেই সব তাত্তি¡ক নেতাদের প্রত্যাখান করে দেশ মাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মুক্তির বিষয়টি তার নিকট বিকল্পহীন হয়ে দাঁড়ায়। তিনি’ই অত্যন্ত দক্ষতা ও সাফল্যের সাথে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে
জাতীয় রাজনীতির বিস্তীর্ণ ময়দানে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। প্রায় ৬০ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং সে লড়াই নিরন্তর চালিয়ে যাওয়া তার অনন্য কীর্তি। আমৃত্যু তিনি রাজনীতি ও শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায়ের
লড়াইয়ে শামিল ছিলেন। সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স
পার্টি ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন এর সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রায়পুর থানা থেকে আবুল বাশার চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট চিটাগাং জুট ম্যানুফ্যাকচারিং লিঃ এ
শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগদান করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাÐের সহিত যুক্ত হয়ে পড়েন। তখন থেকে তার বাম রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৫৬ সালে তার ওপর প্রথম হুলিয়া জারি করে পাক সরকার। ১৯৫৮ সাল থেকেই তিনি হুলিয়া মাথায় নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেন। এসময় তিনি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। তিনি উপলব্ধি করতেন, শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি আন্দোলনের সূতিকাগার ট্রেড ইউনিয়ন হলেও রাজনৈতিক সংগ্রামটাই মুখ্য।পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি চীনপন্থী বা নকশালীদের মত নীতি ও কৌশলে বিশ^াসী ছিলেন না। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন
আপোষহীন। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করে তিনি শ্রমিকশ্রেণীর রাজনৈতিক অবস্থান কি হওয়া উচিত মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের মধ্যদিয়ে তা প্রমাণ করেছেন। আজন্ম তিনি মতাদর্শিক সংগ্রামে অটল ছিলেন। তিনি তার সকল কর্মীকে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বধাীন হওয়ার পর আবুল বাশার সকল সেক্টরের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই ১৯৭৩ সালে গঠন করেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন। পরবর্তীতে জিয়া এরশাদের আমলে বিশ^ব্যাংক ও আইএমএফ’র বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক, নামমাত্রমূল্যে সরকারি মিল-ইন্ডাস্ট্রি বিক্রি, শ্রমিক ছাঁটাই এসব জাতীয় ও শ্রমিক স্বার্থবিরোধী অপকর্মের বিরুদ্ধে আবুল বাশার শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। কমরেড বাশার শুধু শ্রমিকদের ঐক্য নয়। তিনি শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিগুলোরও বৃহত্তর ঐক্য কামনা করতেন। বর্তমান সরকারের ২৫ টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ, শ্রমিক ছাঁটাই, তদুপরি বিশ^ায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদী-সা¤্রজ্যবাদী আগ্রাসন ইত্যকার নানা সঙ্কট, শোষণ-শাসনের প্রেক্ষিতে কমরেড আবুল বাশারের
শ্রমিক আন্দোলন সংগ্রাম ব্যতিত শ্রমিক শ্রেণির ন্যায্য অধিকারের দাবি আদায় সম্ভব নয়। তার জীবনসংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে এদেশে শ্রমিকরাজ, কৃষকরাজ, মেহনতীমানুষের রাজ কায়েম হবে। কমরেড আবুল বাশারের দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই হোক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গিকার।