।। নুর আহমদ বকুল ।।
প্রথম পর্ব-
আজ ৩১ মে শহীদ ডাক্তার জামিল আকতার রতনের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেইন হোস্টেলের দক্ষিন পশ্চিম কোনে ইন্টার্নি হোস্টেলের সামনে দিনে-দুপুরে খুন হন। মানে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধ ফ্যাসিষ্ট জামায়াত ইসলামের খুনী বাহিনী ইসলামী ছাত্র শিবির। খুনীরা জামিল আকতার রতনকে তরবারি দিয়ে জবাই করে “নারায়ে তাকবির আল্লাহু” শ্লোগান দিয়ে নিজেরা পরস্পর আলিঙ্গন করেছিলো ও একে অপরের গালে চুম্বন করেছিলো। তদের এই পৈশাচিকতার আনন্দের উৎস ছিল তারা একজন কাফের মুরতাদকে হত্যা করতে পেরেছে কেননা জামিল ছাত্র মৈত্রী করতো এবং কমিউনিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাস করতো, কমিউনিস্ট ছিলো। ঐ সময় কালে ১৯৮৮ সনের ৩১মে এই রাজনৈতিক হত্যা কাণ্ডটি দেশ ও দেশের বাইরে তীব্রঘৃণা, প্রতিবাদ ও আলোড়ন তুলেছিলো। জামিলের মৃত্যুর প্রায় পৌনে দুমাস আগে আমরা বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের দুটি সংগঠন বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী নাম ধারণ করি। ১৯৮৮ সনের ৭-৮ এপ্রিল প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে এই ঐক্য এক নতুন মাত্রার প্রণোদনা তৈরি করে। কর্মীদের আদর্শবোধ ও সাহসকে আর বাড়িয়ে তোলে। সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ছাত্রআন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠে। নতুন ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সংগঠনে আমি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হই এবং প্রথম সাংগঠনিক সফর করি রাজশাহী। রাজশাহী ছিলো আমার আপন শহর। ১৯৭৭-১৯৮৪ এইসময় কালে জিয়া-এরশাদবিরোধী দুটি সামরিক শাসন ও তাদের সহযোগী জামায়াত-শিবিরবিরোধী লড়াইসহ আমার শিক্ষা জীবন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ছিলো। ছাত্র মৈত্রীসহ আন্যান্য বাম-প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা অনেকেই আমার পরিচিত ছিল। রাজশাহী মেডিকেলে আমার পূর্বের সংগঠন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি থাকার সুবাদে মেডিকেল কলেজটিও ছিলো আমার আপন জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হলে সিট পাইনি প্রায় সাতমাস, তখন মেডিকেল মেইন হোস্টেলে কাটিয়েছি। ঐসময়ে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সংঠনটিও খুবই সাহস ভরা তারুণ্যের শক্তিশালী সংগঠন ছিলো। সংগঠনের কলেবর বৃদ্ধি এবং সাংগঠনিক যোগ্যতা নিয়ে জামিল যখন সভাপতি হন তখন একটি লড়াকু প্রতিবাদী ছাত্রসংঠন হিসেবে ছাত্র মৈত্রীকে অনেকেই ঈর্ষা করতে শুরু করেছে। ছাত্রমৈত্রীর নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার সফরের তৃতীয় দিন ১৯ এপ্রিল ১৯৮৮ সনে সন্ধ্যায় মেডিকেল ক্যম্পাসে যাই। জামিল কর্মী সহযোগে আমাকে বরণ করে। সুন্দর সুশ্রী মায়াবী চেহারার জামিল তার ইউনিটের সাংগঠনিক তৎপরতার কথা বলার জন্য যেন ব্যকুল হয়ে উঠেছে। আমি বললাম যেহেতু রাত দশটায় কর্মীসভা সেখানেই না হয় সব শুনবো। মনে হলো যেন ও খুশি হতে পারলো না আমার উত্তরে। আমার ট্রাভেল ব্যাগটি তখনো ওর হাতে ধরা। তখনই আবার সে বলে উঠলো তাহলে চলেন ক্যাম্পাসে যায় আমাদের দেওয়াল লিখন ও ম্যুরাল গুলো দেখবেন। আমার ব্যাগটি কোন এক কর্মীর মাধ্যমে রুমে পাঠিয়ে দিলো। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সিড়ি দিয়ে নামতেই দোতলায় পূর্ব পাশের দেওয়ালে একটি ম্যুরাল আকাঁ হয়েছে। পশ্চিম দিক অর্থাৎ বন্ধগেটের দিকে দোতালায় সানসেডের উপরদিয়ে দেওয়াল লিখন(চিকামারা) দেখে, মেয়েদের হোস্টেল গেট একাডেমি বিল্ডিং হাসপাতাল দেওয়াল দেখে আবার মেইন হোস্টেলে ফিরলাম।
চিকা ও ম্যুরাল দেখার প্রতিটি মুহূর্তে ওর বর্ণণা, ম্যুরাল আকাঁর আনন্দ ও কৃতৃত্বে বারবার ঝলসে উঠছে। আমিও জীবনে বহুচিকা ঝুকি নিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে লিখেছি। দেওয়াল লেখা, পোষ্টার সাটানো শ্লোগান দেওয়া এগুলি আদর্শতাড়িত কাজ। জামিলকে আমি ঐ দিনই চিনেছিলাম- কি অভুতপূর্ব আর্দশিক মনোভাব নিয়ে ও লড়ছে দৃষ্টান্ত তৈরি করছে। যথারীতি রাতে কর্মীসভা হলো। উদ্দীপনা নিয়ে কর্মীরা যে যার রুমে চলে গেলো। খেতে খেতে রাত্রি প্রায় একটা। জামিল কর্মী সভাতেই তার ক্যাম্পাস রাজনীতিতে অন্যান্য দলগুলির কথা তুলে ধরেছিল। মৈত্রীর কারা মিত্র, কারা শত্রু, কারা ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনে চালাকি করছে। খাওয়ার পরে ভবিষ্যতে করণীয় নিয়ে ওর পরিকল্পনা আলোচনা করতে লাগলো। শিবিরের দিক থেকে বিপদ আসতে পারে তেমনটি আলোচনা সে দিন সে তুলেনি। তবে চিকা লেখা নিয়ে একটা ছোট-খাটো বচসা হয়ছিলো সে কথাটি বলেছিলো। যেহেতু ঐ ক্যাম্পাসে সব সময় একটা টানটান রাজনীতি চলতো আমার অভিজ্ঞতায় তাকে চোখকান খোলা রেখে চলতে বলেছিলাম। রাত চারটে অবধি ওর সংগে গল্প করেছিলাম। গল্প যেন শেষ হয়না। সকাল ৭টায় আমার ঢাকা ফেরার বাস ছিলো। আমাকে বাসে তুলে দিতে আসার সময় অনুরোধ করেছিলো সময় নিয়ে আসতে হবে। খুব শীঘ্রী ক্যাম্পাসে বড় সম্মেলন হবে আমাকে অতিথি হতে হবে। বাস ছেড়ে দিলো জামিল হাত নেড়ে উইশ করতে থাকলো।
২য় পর্ব-
আমার বাস গতি নিলো ঢাকার পথে। বাসে বসেই আমার মনে জামিলকে নিয়ে সংগঠনের জালবুনুনি শুরু হলো। জামিলের সাংগঠনিক দক্ষতা, বলার ধরণ, সংগঠন নিয়ে স্বপ্ন দেখা, সাহস ধরা আসলেই আমাকে আকৃষ্ট করে। ঢাকায় ফিরে সাংগঠনিক কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। একদিকে সাধারণ সম্পাদকের নতুন দায়িত্ব অন্যদিকে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার কাজ। ৮৭ সনে ১০ নভেম্বর জীবন্ত পোষ্টার নুর হোসেনের শহিদীমৃত্যু গণ অভ্যুত্থান মুখী পরিবেশ তৈরী করলেও জাতীয় ঐক্যগড়ে না উঠায় সে যাত্রায় আন্দোলন ভাটার দিকে চলে যায়। এ সময়টাতে ছাত্র আন্দোলনও ব্যাপক ঐক্য নিয়ে দাড়াতে পারছিলো না।
এ অবস্থার পিছনে অন্যতম বাধা ছিল ৮৬ সনে জেনারেল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য। সামরিক শাসন এবং মৌলবাদবিরোধী সংগ্রামে ছাত্র মৈত্রী সবসময় ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনে জোর দিতো। বাপ্যারটি শুধু রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্ন নয় আদর্শিক দিকটিই প্রধান ছিলো।অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের পক্ষে, সামরিক শাষনের বিরুদ্ধে, সমাজ বদলে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের পক্ষে এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। আর সেই পরীক্ষাগার ছিলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ৭৫ পরবর্তীকালে সামরিক জান্তার বুটের তলায় যখন রাষ্ট্র, সংবিধান চলে গেলো, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত শিবিরকে পুনর্জীবিত করা হলো, ৫ম সংশোধনী দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া সংবিধান বদলে দেওয়া হলো, তখনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন (জাতীয় ছাত্রদল ২টি অংশ, জাতীয় ছাত্র আন্দোলন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন) ছাত্র সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে দুঃসাহসিক সব প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে লাগলো। রাজশাহী যাবার পথে জেনরেল জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। পরে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় ফিরেন। রাজাকার বিরোধী সংগ্রাম প্রথম সূচিত হয় সমন্বয় কমিটির ৫ দফা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। ভাইস চ্যান্সেলর রাজাকার আব্দুল বারীর বিরুদ্ধে। রাজাকার বারী অপসারিত হতে বাধ্য হয়েছিলো। সাম্প্রদায়িক খুনি শিবিরের রাজনীতি বন্ধের দাবী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উঠেছিল ছাত্র মৈত্রীর নেতৃত্বে। এরশাদের সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে সর্বপ্রথম জেলে গেছে ছাত্র মৈত্রীর কর্মী। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯০ এই সময়কালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংগে দুই সামরিক জেনারেল, জিয়া এবং এরশাদ বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ৫ম সংশোধনী দিয়ে ৭২র সংবিধান সংশোধন করে জিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে সামনে এনে সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আর এরশাদ ৮ম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটাকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে রুপান্তরিত করছে। এর বিষময় ফল হচ্ছে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির উত্থান এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শ সমাজে, সংস্কৃতিতে, মননে আধিপত্য বিস্তার করেছে। যার বাড়বাড়ন্ত বতর্মান সময়ে এসে ঠেকেছে। বিশেষ করে ঐসময়কালে প্রগতিপন্থী ছাত্র সংগঠনসমুহের উপর হামলা রগকাটা, হত্যা খুন, ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে দেওয়ার মত ঘটনা সৃষ্টি করা হয়েছে। বহুকর্মী খুন ও পঙ্গু হয়েছেন। সামরিকজান্তা এরশাদ তার ক্ষমতাকালীন সময়ে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি গুলিকে সংগঠিত করেছিলো তার রাষ্ট্রধর্মবিল পাশ করানোর জন্য।
৩য় পর্ব-
জাতীয় রাজনীতিতে যেহেতু ভাটার টান এবং বিভক্তি চলছে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্মবিল পাাশ করানোর সুযোগটি ছাড়লেন না। জিয়া এবং এরশাদ জমানায় ৫ম সংশোধনী থেকে ৮ম সংশোধনী রাজনীতির একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ডিসর্কোস ছিলো। উভয় জেনারেলই অত্যন্ত চতুরতার সংগে সম্পন্ন করে। মোটা দাগে বললে তা দাড়ায় পাকিস্তানি চেতনাকরন এবং সেনাবাহিনী থেকে প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরিয়ে দেওয়া। এই সময়কালে পাকিস্তান, সৌদি আরব, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদসহ তথাকথিত ইসলামিক উম্মাহর দেশগুলো ডলার-পেট্রোডলার নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলো। মুসলিম দেশগুলিতে ব্যাপক চাকুরি, শত শত ইসলামিক এনজিওর জন্ম, গ্রামে গ্রামে ইসলামী জলসার নামে জামায়াতের শক্তি অর্জন, জাতীয় অর্থনীতি ও জীবন সংস্কৃতিতে প্রভাব পড়তে থাকলো। আরবি নামে হোটেল, সেলুন, টেইলরিং এর দোকান ব্যবসা, এনজিও প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া শুরু হলো। বোরখা হিজাব, সৌদি জোব্বা বাড়তে শুরু করলো। তালেবান বিপ্লবের রণনীতি রণকৌশল নিয়ে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং পাশ্বর্বতী অঞ্চলে ছাত্র শিবির, ছাত্রসেনা, ছাত্রমজলিস নামে বিভিন্ন ইসলামী জংগী সংগঠনগুলি ঘাটি গাড়তে থাকলো। সামরিক জান্তাদের রাজনৈতিক সহায়ক ইসলামী দলগুলি অর্থবিত্ত ক্ষমতার ভাগ নিয়ে দূদর্মনীয় হয়ে উঠতে থাকে। মন্দির ভাংচুর, সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি, আক্রমন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্রসংগঠন সমুহের উপর প্রতিনিয়ত ঐ জঙ্গী সংগঠনসমুহ আক্রমন পরিচালনা করতো। পাশাপাশি জেনরেল এরশাদ প্রতিসপ্তাহে জুম্মার নামাজ আদায় শুরু করলেন স্বপ্নে নির্দেশিত নতুন নতুন মসজিদে। সেখান থেকে ধর্মীয় বাণী রাষ্ট্রীয় বাণী প্রচার করতে থাকলেন।পীর বাড়ী, মাজার দর্শন বাড়িয়ে দিলেন। সামরিক শাসন ও জংগীবাদী ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিদিন ইঞ্চি ইঞ্চি লড়াই সাজাতে হতো আমাদের চেতনার বাতিঘরগুলো দখলে রাখতে হতো। ১৯৮৮ সনের ১১মে তারিখে এরশাদের চামচা মন্ত্রী মওদুদ আহমদ রাষ্টধর্ম বিলটি তথাকথিত পার্লামেন্টে উত্থাপন করার পরেই দেশব্যাপী ছাত্রদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদে এগিয়ে আসে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু হয়। যার যার জায়গা থেকে আন্দোলন চলতে থাকে।
এরশাদ তার নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য সামরিক গোয়েন্দা রাজনৈতিক শাখাকে ব্যবহার করতেন।জেনারেল জিয়া এই পথের প্রদর্শক, তার ক্ষমতাকালে প্রায়শই এই হাতিয়ারটির অবৈধ ব্যবহার করতেন। যাই হোক এরশাদ রাষ্ট্রধর্মবিল পাশ করবেনই সেহেতু অতিসামনের বাধা ছাত্র আন্দোলনকে ঠেকাতে চাইলেন এবং তার গোয়েন্দা মেশিন ব্যবহার শুরু করলেন। সারাদেশে ছাত্র মৈত্রী কর্মসূচি চালিয়ে যেতে লাগলো। রাজশাহীতে জামিল আক্তার রতন তার কলেজে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকলেন। ২৭ মে তারিখে একটি বড় মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেছিল। আমরাও নানান গল্পগুজব শুনতে লাগলাম। কয়েকদিনের মধ্যে অর্থাৎ ৩১মে তারিখে আমাদের সূর্য্যসারথী ডাক্তার জামিল আকতার রতনের ভয়াবহ হত্যা কাণ্ডের খবরটি পেলাম দুপুরে।আমাদের মৈত্রী অফিস তখন ৮/১নীলক্ষেত বাবুপুরায়। আশে পাশে সব প্রিন্টিং প্রেস। ঐ প্রেস গুলির মালিকেরা আমাদের জরুরি যোগাযোগের জন্য সবসময় তাদের টেলিফোন ব্যবহারের সুযোগ দিতেন। ঐ মুহুর্তে তারকালোকের টেলিফোনটি খবরের ভরসা স্থল হলো। এ ক্ষেত্রে যা হয় ,অথেনটিক খবর পাওয়া খুব দুস্কর হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত হৃদয় বির্দীণ করা চুড়ান্ত খবরটিই পেলাম আমাদের প্রিয় কমরেড জামিল আকতার রতনকে শিবিরের কসাইরা নির্মম ভাবে তরবারি দিয়ে জবাই করছে, হাত পায়ের রগ কেটেছে, যে টুকু জীবন প্রদীপ ছিলো তা নিঃশেষিত করতে পুনরায় তরবারি দিয়ে খুচিয়েছে। আমাদের সভাপতি জহিরুদ্দিন স্বপন, সহ সভাপতি সিরাজুম মুনীরসহ আরো নেত্রীবৃন্দ এক সংগে করণীয় নির্ধারণে বৈঠক করলাম। রাজশাহী কে যাবেন প্রেস রিলিজ কি হবে, পোষ্টার লিফলেট কে লিখবে ছাপাবে। প্রতিমহুর্তে বাদশা ভাইয়ের সংগে যোগাযোগ রাখা, জেলাগুলির সংগে খবর বিনময় করা এক যুদ্ধকালীন জরুরীত্বর মধ্যে পড়ে গেলাম। জামিল হত্য্যর খবর চাউর হবার সংগে সংগে সারাদেশে ছাত্রমৈত্রী প্রতিবাদ প্রতিরোধে নেমে পড়েছিল। পচিশটি জেলায় সক্রীয় প্রতিরোধ গড়েছিলো নেতাকর্মীরা। কোন নির্দেশ লাগেনি। ধর্মান্ধ নরপশু গুলি পালিয়ে জান বাচিয়েছিলো। এরশাদের প্রশাসন আশ্রয় দিয়েছিলো। নেতাকর্মীদের জানবাজি পাঞ্জা লড়ার সাহস যুগিয়েছিলো আদর্শবোধ আর কমরেড হারানোর বেদনা। ৩৩ বছর পরেও আমি যখন জীবন্ত ইস্পাত দৃঢ় স্বাপ্নিক মায়াবী জামিলকে দেখি মনের আয়নায় তখন মন হয় জামিল মরেনি। পাশাপাশি ছাত্র মৈত্রীর সেই রাগী তরুনেরা চোয়াল শক্ত করে তীব্র হুংকারে ভয়হীন চিত্তে প্রতিরোধে নেমেছিলো স্বজন হারনোর শোকে তাদের এখনো মনে রাখি দারুন ভালবাসায়। জামিলের হত্যকাণ্ডটি ছিল নিখুত পরিকল্পনার ছক। সামরিক শাসনের শুরুতেই বহিরগত নিয়ে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দখলের সামরিক পরিকলপনা আমরা প্রতিরোধ করে ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। এর জন্য শিবিরের করা মিথ্যা হত্যা মামলায় আমাদের ১৪ জন ছাত্রনেতাকে বগুড়া সামরিক আদালতে যাবৎজীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হয়েছিলো। তখন থেকেই সামরিক সরকার তার এজেন্সি এবং শিবিরকে দিয়ে তাদের পরবর্তী পরিকল্পনা আকতে থাকে। বেছে নেয় ছাত্র মৈত্রীর আরেক শক্তিভূমি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ। হত্যার জন্য বেছে নেয় আপোষহীন নেতা জামিলকে। এখনও আমার কাছে প্রশ্ন থেকে গেছে মেডিকেলে ছাত্র শিবির শক্তিশালী সংগঠন না হয়েও কেন আক্রমন করার সাহস পেলো? যা হোক সে এনালাইসিস পরে কোন লেখায় করবো। জামিলের রক্ত বিভক্ত ছাত্র আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ১৯৮৮ সালের ৪ঠা জুন তারিখে জামিল হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা জি পি ও এর সামনে ১৬ টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে হাজার হাজার ছাত্র জনতা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র মৈত্রী ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেছিল। এটিই ছিল নতুন ভাবে সামরিক জান্তাবিরোধী উচ্চতর লড়াই। আজ ৩১মে কমরেড জামিলের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার প্রিয় সংগঠন ছাত্রমৈত্রী ও প্রিয় পার্টি ওয়ার্কার্স পাটি তাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে যে যেখানে আছে সেখান থেকেই।করোনাকালের এই পৃথিবীতে এই বাংলায় হাজার লক্ষ জামিলের জন্ম হোক। যে জামিলেরা ভোগবাদ, সুবিধাবাদ, ব্যাক্তিবাদ, ধান্ধাবাদকে না বলবে। ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রীয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যোদ্ধা হবে। লুটেরাদের বিরুদ্ধে মানবিক সমাজের জন্য লড়বে। বাংলাদেশ ভালো নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল ভিত্তি চার নীতি পথ হারিয়েছে। পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তার জন্য চায় ঐক্য। মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ছিল জনগণের ঐক্য। সংকীর্ণতা ভুলে জামিলের আদর্শের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। জামিল লাল সালাম। জয় হোক তোমার আদর্শের। জয় সমাজতন্ত্র।
বিনম্র শ্রদ্ধা ও লাল সালাম।
লেখক: পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।