চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কমিউনিস্ট বিপ্লবী হায়দার আনোয়ার খান জুনো। গত দেড় মাস ধরে দুই হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের কাছে হার মানলেন। কিন্তু একাত্তরের রণাঙ্গনে তিনি হার মানেন নি। হার মেনেছিল পাকবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়েই শিবপুর সমগ্র অঞ্চল পাক হানাদার মুক্ত ছিল। শিবপুর অঞ্চলে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে পাঁচ-পাঁচটি সম্মুখ যুদ্ধ করেছিলেন জুনো। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকবাহিনীর হাত থেকে বিশাল অস্ত্রভাÐারসহ তাদের নরসিংদীর ক্যাম্প দখল করেছিলেন। এ ধরণের একটি যুদ্ধের সাহসিকতার জন্য তিনি উপাধি পেতে পারতেন। কিন্তু জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটে নাম তোলার জন্য দীর্ঘ আড়াই বছর লড়াই করতে হয়েছে। জামুকা’র পরীক্ষকদের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল তা নয়। কারণ উপুর্য্যপুরী সরকারের তালগোল পাকানো মুক্তিযোদ্ধা গেজেট নাম না উঠলেও স্বাধীনতার দলিলে তার ও শিবপুরের রণাঙ্গানের যুদ্ধসমূহের গৌরবজনক বিবরণ আছে। বস্তুতঃ সম্প্রতি সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা নিয়ে সরকার আরেক দফা উদ্যোগ গ্রহণ করলে শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ অনুরোধে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি’র একজন হিসাবে আমি মাননীয় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে সমন্বয় কমিটির চৌদ্দটি মুক্তিযুদ্ধ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিই। দীর্ঘ তদ্বির তদারকের পর পরীক্ষা দিয়ে হায়দার আনোয়ার খান জুনোসহ তার কিছু সংখ্যক সহযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত করা হয়। তার অসুস্থ থাকা অবস্থায় ঐ গেজেটের কপি তার বাসায় পৌঁছে দিলেও তিনি তা স্বচক্ষে দেখে গেছেন কিনা জানি না। কারণ এবার অসুস্থতার প্রথম থেকেই তিনি অচেতন অর্ধচেতন অবস্থায় ছিলেন। যাই হোক এটা আনন্দের যে তার বিদায় মুহুর্তে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানান হয়েছে। তার শিবপুরের সহযোদ্ধারা উপস্থিত থেকে সেটা দেখছেন। অন্ততঃ জেনেছেন যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তাদের নেতা লড়াই করেছেন রাষ্ট্র তাকে সেই সম্মান জানিয়েছে।
পাক হানাদার বাহিনীর কাছে তিনি যেমন হার মানেন নি, তেমনি হার মানেন নি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। ছাত্র জীবনে যে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন তা তিনি অব্যাহত রেখেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। ক্ষেত্র বদলেছে, কিন্তু তিনি তার লড়াই জারি রেখেছিলেন। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন দিয়ে যে সংগ্রামের জীবন শুরু তাই বিস্তৃত হয়েছে তার প্রিয় ছাত্র সংগঠন-ছাত্র ইউনিয়ন গড়ার ক্ষেত্রে। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশ যখন জেলে তখন ঐ সংগঠনকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছেন প্রায় এককভাবে, তার প্রজন্মের কর্মীদের সাথে নিয়ে। পরবর্তীতে হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর সহ-সভাপতি। বীরদর্পে লড়েছেন এনএসএফ-এর তাÐবের বিরুদ্ধে। ঊনসত্তরে ঐক্যবদ্ধ করেছেন ছাত্র সংগঠনগুলোকে ঐতিহাসিক এগার দফা কর্মসূচিতে। শহীদ আসাদুজ্জামানের উত্তরাধিকার নিয়ে সংগঠিত করেছেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।
ইতিমধ্যেই তার হাতেখড়ি হয়েছে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে। পারিবারিকভাবেই রাজনীতি, বিশেষ করে কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রভাবে ছিলেন। নানা সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন বেঙ্গল এসেম্বলির স্পীকার। পরে কংগ্রেস হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র ভারতের রাজ্য সভার সদস্য হন। মামা মনসুর জিলানী বাংলার নৌ পরিবহন শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন। ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংযুক্ত। বড় ভাই হায়দার আকবর খান রনো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ষাটের দশকে যে এক ঝাঁক তরুণ ছাত্র আন্দোলন থেকে সে সময়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন তাদের প্রথম সারির নেতা। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন সে সময়ের তরুণদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে দিয়েছে। ষাটের দশকের বিশ^ বাস্তবতা তাদের স্বপ্ন দেখাতে বিপ্লব সংঘঠনের স্বপ্ন দেখাত, সমাজ পরিবর্তনের। আর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ও স্বাধীনতা এবং বিপ্লবের সেই স্বপ্নের ভিত্তিতে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তরুণ কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা যে “কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি” গড়ে তুলেছিলেন তিনি ছিলেন তার অন্যতম কেন্দ্রীয় সদস্য। আর কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর রূপান্তর ঘটালেন ‘পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’ হিসেবে। ছিলেন তার প্রথম সভাপতি। আর এই বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে ১৯৭০-৭১-এর সেই ঐতিহাসিক সময়ে গড়ে তুলেছেন ঢাকাতে ছাত্রদের নিয়ে গোপন গেরিলা স্কোয়াড। একাত্তরের মার্চে সমস্ত দেশ স্বাধীনতা ও মুক্তির আকাক্সক্ষায় জ¦লে উঠলে, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসেবে সংগ্রহ করতে শুরু করলেন বন্দুক-রাইফেল ও বোমা বানানোর সরঞ্জামের।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালো রাত পোহাতে আর দেরি করেন নি। কার্ফু উঠে যেতেই ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’র নেতৃবৃন্দ ও সংগৃহিত কিছু অস্ত্র নিয়ে গাড়ী চালিয়ে উপস্থিত হলেন নরসিংদীর শিবপুরে। এই শিবপুরই হয়ে উঠেছিল তার রণাঙ্গন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মান্নান ভুইঞার নেতৃত্বে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি’র হেড কোয়ার্টার। আর দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে হায়দার আনোয়ার খান জুনো পাঁচটির উপর, পাক বাহিনীর সাথে সরাসরি ফ্রন্টাল যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি’ অন্যান্য কমিউনিস্ট গ্রæপকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠন করলে তিনি তার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পরে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে গোপনে নিয়ে রাজনৈতিক ফ্রন্ট হিসেবে ইউপিপি গঠিত হলে তিনি তার সাংস্কৃতিক সম্পাদক হন। ঐ ইউপিপি আবার কাজী জাফরের নেতৃত্বের সামরিক শাসক জিয়ার ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে’ যোগ দিলে আমি, রনো, নজরুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যারা বেরিয়ে এসে ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন নামে প্লাটফর্ম গঠন করেছিলাম জুনো ছিলেন তার অন্যতম নেতা। ১৯৮১-তে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) ওয়ার্কার্স পার্টির নাম নিয়ে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলে তিনি তার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন।
ইতিমধ্যে তিনি রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে মূলতঃ সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে নিজেকে নিয়োজিত করেন। দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’ থেকে বেরিয়ে এসে ‘ক্রান্তি’ গঠন করলে জুনো তার অন্যতম সংগঠকে পরিণত হয়েছিলেন। তাদের কাকরাইলের বাসায় ‘ক্রান্তি’র শিল্পীরা শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু চক্রবর্তী, অজিত রায় প্রমুখদের নেতৃত্বে তাদের রিহার্সেল করতেন। জুনোর নেতৃত্বে ‘ক্রান্তি’র এই শিল্পীরা দেশের শিল্পাঞ্চলসহ গ্রামাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতেন।
বাংলাদেশ পরবর্তীকালে ‘ক্রান্তি’ পুনর্গঠিত করার চেষ্টা হলেও সেটা হয়নি। পরবর্তীতে ‘জুনো’ নিজেই ‘সৃজন’ নামের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এবং ‘সৃজন’কে নিয়ে বিপ্লবী ধারার সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট হিসেবে গড়ে তোলেন ‘গণসংস্কৃতি ফ্রন্ট’। এই ‘গণসংস্কৃতি ফ্রন্ট’কে নিয়েই ছিল তার শেষ দিককার কার্যক্রম। ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ‘বাংলা ভিশন’ প্রতিষ্ঠা করলে জুনোকে তার সাথে যুক্ত করেছিলেন। ‘বাংলা ভিশনে’র নাটকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের রিভিউ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক প্লাটফর্মে তার সর্বশেষ উপস্থিতি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে এ বছরের ২২শে ফেব্রæয়ারি বিএমএ মিলনায়তনে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ দিবস অনুষ্ঠানে।
ছাত্র জীবনে মেধাবী হায়দার আনোয়ার খান জুনো সেন্ট গ্রেগরীস্কুল ও নটরডেম থেকে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যায় এমএসসি করেন ও প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। তিনি বাংলায় পদার্থ বিদ্যার উপর দু’টি খুব জনপ্রিয় বই ছাড়াও তার শিবপুর রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : শিবপুর’ ও ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘আগুনঝরা সেই দিনগুলি’। সময় দুঃসময় নামে একটা উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। সবই অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ, আবার সুখপাঠ্য।
জুনো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইউওটিসি’র সদস্য হিসেবে ‘পলো’ খেলা ও ‘শুটিং’য়ে চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। কিছু অন্তমুখী, সদালপী, সদাউজ্জ্বল জুনো এই পৃথিবীর মাটি থেকে চলে গেলেও, এদেশের মানুষের স্মৃতিতে জ¦ল জ¦ল করবেন।
লেখকঃ সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।