Wednesday,4,December,2024
22 C
Dhaka
Wednesday, December 4, 2024
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যজাতীয় কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ

জাতীয় কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২ তম জন্মবার্ষিকী’র অনন্য আজকের এই দিনে কবির প্রতি নিবেদন করছি ফুলেল শুভেচ্ছা এবং অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ।শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করছি জাতির স্হপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি।তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি স্বপরিবারে বাংলাদেশে আসেন।বঙ্গবন্ধু’র সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেণ এবং জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেন। সেদিন এ মহৎ কাজটি’র জন্যই কবিকে ‘জাতীয় কবি’র’ মর্যাদার আসনে বসাতে পেরেছি।এটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধু’র হিমালয়সম বিশাল জনপ্রিয়তা এবং ব্যক্তিত্বের কারণে। ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে)১৩০৬ বঙ্গাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে নবজাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম।দুই বাঙলার বাঙলা ভাষি মানুষের কাছে কবির সাহিত্যমুল্য অসামান্য। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্ট বাঙলা সাহিত্যের বিশাল ধারার বাইরে কবি নজরুল গড়ে তোলেন আলাদা সৃজনশীল ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের নতুন ধারা। ধুমকেতুর মতো কবি নজরুলের আগমনকে, আলাদা বৈশিষ্ট্যের অভ্যুদয়কে রবীন্দ্রনাথ স্বাগত জানিয়ে বলেছেন,’ আয় চলে আয়রে ধুমকেতু,আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু’।বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ভূষিত হয়েছেন, ‘ বিদ্রোহী কবি,সাম্যের কবি,রোমান্টিক ও বিরহ- বেদনার কবি হিসেবে।বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়েছিল বাঙলাভাষী মানুষের ঘরেঘরে।কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অভিক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে,বৈষম্যের শৃঙ্খল ভাঙার লড়াই-সংগ্রামে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর রচনা ছিল অনবদ্য। তিনি অভিবক্ত বাংলার কমিউনিস্ট নেতা মোজাফ্ফর আহমেদের সংস্পর্শে এসে হয়েছিলেন সাম্যের কবি।সাম্যবাদী কবি।মানুষে মানুষে বিভাজন,জাতপাত,ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা স্বোচ্ছার। তিনি মানুষকে ধর্মের পাল্লায় বিভাজিত করার ‘রাজনীতি-সমাজনীতি’ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।রচনা করেছেন সাম্যের গান-‘ গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,নহে কিছু মহিয়ান’—।কুলি- মজুর’ কবিতায় কবি বলেছেন,’ দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবু সা’ব ঠেলে দিলে নিচে ফেলে’! চোখ ফেটে এল জল,এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল’ –।
১৯২৫ সালে কলকাতা থেকে কবি নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় বের হতো বিখ্যাত পত্রিকা ‘লাঙল’।এই পত্রিকায় নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ রাজনৈতিক দর্শনের প্রকাশ ঘটেছে।পত্রিকাটির প্রত্যেক সংখ্যার শুরুতেই লেখা থাকতো কবি চণ্ডীদাসের অমর বানী, ‘ শুনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই।’ পত্রিকাটির প্রচ্ছদ আঁকা থাকতো ‘ লাঙল কাঁধে এক কৃষকের ছবি’।অবাককান্ড! সেই সময়কালে ওই পত্রিকা ছাপা হতো ৫ হাজার কপি।কয়েক ঘন্টার মধ্যে তা বিক্রি হয়ে যেতো। পত্রিকাটিতে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতো গোর্কির মা-মার্কস,লেনিনের বিভিন্ন রচনা।পত্রিকাটিতে নিয়মিত লিখতেন সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর,মুজফ্ফর আহমেদ। কৃষাণের গান,সব্যসাচী, সর্বহারার মতো কবিতা কবি নজরুল সম্পাদিত ‘ ‘লাঙল’ পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো। বাংলা সাহিত্য- সংগীতে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের পরিচিতি বহুমাত্রিক। তিনি ছিলেন কবি,সংগীতজ্ঞ, উপন্যাসিক,গল্পকার,নাট্যকার,প্রাবন্ধিক,সাংবাদিক, গায়ক,অভিনেতা ও চলচিত্রকার।তিনি অাধুনিক কবি ছিলেন।তিনি তাঁর কবিতা রচনা করেছেন মানুষের সহজবোধ্য ভাষায়।চলমান আধুনিক বাংলা কবিতার দুর্বোধ্য ভাষা রীতির সঙ্গে নজরুলের ভাষা রীতির পার্থক্য অনেক।নজরুলের কবিতার ভাষা ছিল মুটে-মজুর, কুলি- চাষার ভাষা।যা সহজেই মানুষের হৃদয় কেড়ে নিতো।শিশু- তরুণ’রাও তাঁর রচিত কবিতায় সবসময় থাকতো সজিব ও উজ্জীবিত। আমরা ষাটের দশকে স্কুল পাঠ্যে নজরুলের ‘ খোকার সাধ’ কবিতা পড়তাম।পরবর্তীতে স্বাধীকার আন্দোলনে শিশু-তরুণদের মুখেমুখে তা কন্ঠলগ্ন গীতে পরিণত হয়।সেকি হৃদয়স্পর্শি আশাজাগানিয়া কবিতা-!’ আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে’!।ষাটের দশকে পড়ুয়া সকল শিক্ষার্থী’র মুখে এখনো আটার মতো লেগে আছে ওই কবিতার পংক্তি।
নজরুলের গানের মাত্রা ছিল ভিন্নতর। তাঁর অধিকাংশ গান সুর প্রধান।তাঁর গানে দোলখেতো বৈচিত্র্যময় সুর।সুরের মূর্ছনা কাব্য কথাকে তরঙ্গায়িত করেছে নজরুলের গানে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন,ভাষা আন্দোলন,উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরেরের মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশে স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রতিটি লড়াই- সংগ্রামে নজরুলের গান,কবিতা-সংগীত থেকে আমরা পেয়েছি অফুরান অনুপ্রেরণা।’কারার ওই লৌহকপাট’- গানটি এখনো আমাদের রক্তকণিকায় ঝংকার তোলে। ‘ চল চল চল’ স্বাধীন বাংলার রণসংগীত।কবির জীবনকাল ৭৭ বছর হলেও তিনি ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে অসুস্থ হন।এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটিয়েছেন।দু:ষহ নির্বাক জীবনকে কিছুটা আনন্দময় করতে বঙ্গবন্ধু তাঁকে তার পরিবারকে নিয়ে আসেন বাংলায়।স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। শেষ জীবনে বঙ্গবন্ধুকে অপলক দৃষ্টিতে দেখেছিলেন কবি,জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবি নেই।কবির অমৃত বাণী আমাদের এখনো পথ দেখায়।দ্রোহ,প্রেম,মানবতা ও সাম্যের কবির রচনা এখনো শ্বাশত,চীরন্তন।তোমাকে নিবেদন করছি বিনম্র শ্রদ্ধা।জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ ও সেলুট।
লেখকঃ নজরুল ইসলাম হক্কানী, পলিটব্যুরো সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

সর্বশেষ