ডাকসু নির্বাচন: তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ- কেন্দ্রীক রাজনীতিকে সমর্থন কেনো করেনি?

গতবছর এক ছাত্র- তরুণ  রেজিম চেইঞ্জের বর্ণিল অভূত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক রাজনীতিতে একটা নতুন ধারার সূচনা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। গতকাল (৯ সেপ্টেম্বর)  ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলে তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলা যায়। 
ডাকসুর নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায় ইসলামী ছাত্র শিবির সমর্থীত প্যানেলের অধিকাংশই বিপুল ভোটে জয়লাভ করে।  এর অনেকের কাছে এটা অনুমেয় ছিল আবার অনেকে তা বিশ্বাস করতে চায়নি। যারা অনুমান করেছিল এবং যারা বিশ্বাস করতে চায়নি – উভয় পক্ষই রেজিম চেইঞ্জের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ছাত্র শিবির ডাকসুকে তাদের পকেটে নিয়ে নিয়েছে।  কারচুপি,  ভিসি ও প্রক্টরবাহিনী ও একদল শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিবিরের পক্ষে প্রভাব বিস্তার ও ফলাফলে ইন্জিনিয়ারিং এর অভিযোগ সত্ত্বেও শিবিরের সাথে অন্যান্য পক্ষের ভোটের ব্যবধান বেশ বেশি পরিলক্ষিত হয়। ছাত্রদলের প্রার্থীরা যারা বড় দল হিসেবে জয়ী হওয়ার কথা ভেবেছিল তারা আশানুরূপ ভোট পেতে ব্যর্থ হয়। তারা তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করতে পারেনি। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তৃতীয় এবং বামপন্থী কথিত প্যানেল সমূহ ভোটের বাক্সে চতুর্থ ও পঞ্চম হয়। উল্লেখ করার বিষয় হলো অন্যান্য প্যানেল যেমন সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের দল বা অন্যরা তেমন নজর কাড়তে পারেনি।
ডাকসুতে শিবিরের জয়ের যমন অনেক গভীর  কারণ রয়েছে তেমনি তাদের বিজয়ের প্রভাবও অনেক গভীর।  সামনের সময়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে।  কিন্তু সাদামাটাভাবে ডাকসুর ফলাফলের বিশ্লেষণ করলে জয় পরাজয় যেমন ব্যাখ্যা করা যায় তেমনি রাজনীতির ধারা সম্পর্কেও আঁচ পাওয়া যাবে। 
বাংলাদেশে গতবছর রেজিম চেইঞ্জের নামে যে বর্ণিল আন্দোলন হয়েছিল তাতে,  জামাত- বিএনপি,  ধর্মভিত্তিক দল ও বেশকিছু বামপন্থী দল এক হয়ে গিয়েছিল। এমনকি স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রশ্নে সেই সব বামপন্থীদের অবস্থান হলো, ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলনে স্বাধীনতার প্রশ্ন আনার যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া, দেশে একটা মার্কিন প্রভাবিত এবং  মৌলবাদ ও সেনাসমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাদের অংশ গ্রহণ ও স্বতঃস্ফূর্ততা চোখে পড়ার মতো।  আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলেকে ফ্যাসীবাদী শক্তি আখ্যায়িত করে তাদের নিষিদ্ধ দাবি করে ডান ও বামদের এই ঐক্য রাজনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন আনলো যার অভিমূখ হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে খাটো ও খারিজ করে একটা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া। এর ফলে ছাত্র তরুণদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে পুরনো ধারার রাজনীতি দিল্লি ও পাকিস্তানের মধ্যে টানাটানির রাজনীতি এবং তারা আওয়ামী লীগ, দিল্লি এবং তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে একরশিতে ট্যাগ করে ভিন্ন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করেছে। এই ন্যারেটিভ যেমন সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়েছে তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ধারণাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর ফলে বিশেষ করে দূর্নীতি ও বৈষম্য রোধ করে সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের দাবি ও রাজনীতি সাইডলাইনে চলে যায়। এইসব কিছুর প্রভাব ডাকসু নির্বাচনে পড়েছে। 
শিবিরের ডাকসু জয়ের পেছনে আরও বেশকিছু কারণ কাজ করেছে।  প্রথমত জামাত-শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদ সহ সকল প্রশাসনিক পদে নিজেদের লোকের নিয়োগ নিশ্চিত করেছে।  দ্বিতীয়ত, গত এক বছর তারা সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে হল সমূহ ও ক্যাম্পাস দখলে রেখেছে।  নিজেদের এক অংশকে গোপন রেখেছে,  ছাত্রী সংস্থাকে প্রকাশ্যে এনেছে।  তৃতীয়ত,  গত এক বছরে শিক্ষার্থীদের ইফতার ও সেহরি করিয়েছে, হলে হলে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে। চতুর্থত, এক হিসেবে গত একবছরে প্রায় পনের কোটি টাকা খরচ করেছে,  পরিকল্পিত ভাবে। পঞ্চমত,  ছাত্রদল ও অন্যান্য সংগঠনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মধ্যে মতামত তৈরি করেছে। সবদিক মিলিয়ে গত এক বছর শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জনবিচ্ছিন্ন করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে।  ছাত্রদল ও অন্যান্যরা তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। পরে নির্বাচনের সময়, তারা শিবিরকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে প্রচার করেছে যা ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি কারণ তারা একবছর আগেই তুমি কে আমি কে স্লোগান দিয়ে এই রাজনীতিকে খারিজ করে দিয়েছে।  ষষ্ঠত, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অধিকাংশই মাদ্রাসা বোর্ড থেকে পাশ করে এসেছে।  এদের কাছে শিবিরের পরিচিতি আগে থেকেই আছে।  সব মিলিয়ে শিবিরের সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সব উদ্যোগের কাছে ডাকসু নির্বাচনে অন্যরা পরাজিত হয়েছে। 
ডাকসু নির্বাচনের এই ফলাফল কি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে? এর উত্তরে বলা যায়,  অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। প্রাথমিকভাবে  তা হলো, তরুণ ভোটাররা জামাতকে ভোট দিতে উৎসাহিত হবে। ভবিষ্যতে এর সামাজিক রাজনৈতিক প্রভাব গেড়ে বসবে। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি নিয়ে এতটুকু বলা যায়, শিবিরের রাজনীতিকে তারা ফুল দিয়ে বরণ করবে। এরপরেও  আগামী দিনে ধর্মীয় সহিংসতা রোধে  অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতির হাওয়া প্রবল হবে। অন্যদিকে চব্বিশের চেতনাধারী বামপন্থী রাজনীতি তথাকথিত সিভিল সোসাইটি রাজনীতিতে আবদ্ধ হয়ে নিঃশেষ হবে। ফলে সামাজিক রাজনৈতিক দ্বন্ধের পরিবর্তিত সমীকরণে হয়তো নতুন ধরনের সমতামুখী, বৈষম্য বিরোধী ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকশিত হবে।
 
লেখক-  শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক