তদন্তের স্বার্থে কোনো মামলার প্রতিবেদন দিতে সময় নিতে পারে তদন্তকারী সংস্থা। তাই বলে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবিশেষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আগাম জামিন দেওয়া উচিত নয়। গত ৬ মার্চ প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চের দেওয়া এক আদেশে এ অভিমত এসেছে।
‘রাষ্ট্র বনাম মো. কবির বিশ্বাস’ মামলার রায়ের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে আপিল বিভাগের এ আদেশে।
৭৫ ডিএলআর (ঢাকা ল রিপোর্ট)-এ সম্পাদিত আপিল বিভাগের এই রায়ে বলা হয়েছে, ‘আগাম জামিন সংশ্লিষ্ট বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করার সময় হাইকোর্টকে অবশ্যই সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া সিদ্ধান্ত বা নির্ধারিত নীতি অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, হাইকোর্ট বিভাগ এখতিয়ার ও ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করে অপ্রত্যাশিত আদেশ দিচ্ছেন। হাইকোর্ট বিভাগের এমন অযৌক্তিক আচরণে আমরা (আপিল বিভাগ) উদ্বিগ্ন। এ ধরনের অবমাননাকর প্রবণতা আইনি প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ফলে আমাদের অভিমত হচ্ছে, আগাম জামিনের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ও অন্য সব আদালত ‘রাষ্ট্র বনাম অধ্যাপক ড. মোরশেদ হাসান খান এবং অন্যান্য’ মামলার রায়ের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে বাধ্য। একই সঙ্গে আগাম জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে এখতিয়ার বা ক্ষমতার অনৈতিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হাইকোর্ট বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হলো।’
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গত বছর ২৮ অক্টোবর সমাবেশ ডাকে বিএনপি। ২০ শর্তে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেয় ঢেকা মহানগর পুলিশ।
ওই দিন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরুর আগেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান দলটির নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষের একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে আহত এক পুলিশ সদস্যেরও মৃত্যু হয় সেদিন। সংঘর্ষের এ ঘটনায় রমনা, পল্টনসহ রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৩৯টি মামলা করে পুলিশ।
এসব মামলার মধ্যে রমনা থানায় এক মামলায় গত বছর ৮ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও দলটির যুগ্ম মহাসচিব এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন।
বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাঁদের পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত জামিন দেন। হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এম আমিন উদ্দিন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
আর জামিন আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সগির হোসেন লিয়ন। শুনানি শেষে সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের আদেশ সংশোধন করে আদেশ দেন। পুলিশ প্রতিবেদন দেওয়া পর্যন্ত নয়, জয়নুল আবেদীন ও এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে আট সপ্তাহের আগাম জামিন দেন আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে বলে দেওয়া হয়, আগাম জামিনের এই সময়ের মধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণ করে তাঁরা যদি জামিন আবেদন করেন, তবে তা বিবেচনা করতেও বলে দেওয়া হয় আপিল বিভাগের আদেশে।
‘রাষ্ট্র বনাম আবদুল ওয়াহাদ শাহ চৌধুরী’ মামলার রায় উদ্ধৃত করে আদেশে বলা হয়, পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা পর্যন্ত বিবাদীদের (জয়নুল আবেদীন ও এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন) আগাম জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্র বনাম আবদুল ওয়াহাদ শাহ চৌধুরী’ মামলার রায়ে দেওয়া আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নেননি। তদন্তের স্বার্থেই কোনো মামলায় পুলিশ প্রতিবেদন দিতে সময় লাগতে পারে। তাই বলে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবিশেষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আগাম জামিন দেওয়া উচিত নয়। পুলিশ প্রতিবেদন দেওয়া পর্যন্ত আসামি আগাম জামিনের সুবিধা ভোগ করার অধিকার রাখে না।