ভেজাল খাদ্যের ভয়াল থাবায় বাংলাদেশ
এম এইচ নাহিদ ॥ ‘সুস্বাস্থ্যের মূলনীতি, নিরাপদ খাদ্য ও স্বাস্থ্যবিধি’-এই প্রতিপাদ্যে ২ ফেব্রুয়ারি পালিত হলো জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। ২০১৮ সাল থেকে যথাযথ আয়োজনেই দিবসটি পালন করছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে দেশের মানুষ কি নিরাপদ খাদ্যের গ্যারান্টি পেয়েছে! বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, ‘না’। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আইন’, ১২টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৪৬৩টি প্রতিষ্ঠান, ৬৪ জেলায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত, ৬টি মেট্রপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থাকলেও দেশবাসীর কাছে আজো নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি অধরা। বরং মুনাফাখোর মানব নামের দানবদের কবলে মানুষ প্রতিদিন খাবারের নামে বিষ পান করে তিলে তিলে মরছেন। পুরো দেশ ভেজাল খাদ্যে সয়লাব এবং তার কারণে দেশজুড়ে নীরব হত্যা চললেও এখনো ‘নখদন্তহীন’ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে দানবের দল আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
গত বছরের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন তথ্য বলছে, ভোগ্যপণ্যের ৪৮ শতাংশই ভেজাল। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিউিটের তথ্য অনুযায়ী খাদ্যে ভেজাল ৫০ শতাংশ। অন্য এক তথ্য বলছে, শিশু খাদ্যের ৯৫ শতাংশ ভেজালে ভরা। বছরে মোট শিশুমৃত্যুর ১০ শতাংশ মারা যায় ভেজাল খাদ্যের কারণে। দেশে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ। এ রোগে বছরে মৃত্যু দেড় লাখ। ’৮০-র দশকে ডায়েবেটিসের রোগী ছিল মাত্র ১০ লাখ, এখন তা ৮০ থেকে ৯০ লাখের ওপরে। কিডনি রোগে আক্রান্ত ১০-১২ লাখ মানুষ। ২০-২৫ শতাংশ মানুষ হৃদরোগে ভুগছেন। আর বিকলঙ্গ শিশু এখন ১৫ লাখের ওপরে। বাড়ছে লিভার সিরোসিরের রোগী। কেবল তাই নয়, ডায়েরিয়া থেকে ক্যান্সার-প্রায় ২ শতাধিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ। এসব রোগে বছরে ৪৫ লাখ মানুষ ভুগছেন শুধুমাত্র ভেজাল খাদ্যের কারণে।
প্রতিদিন মানুষ যে পুষ্টির আশায় দুধ পান করেন, তা বলতে গেলে দুধ নয়, সবাই মিলে বিষ পান করেন। কারণ গরুর শরীরে টিটুইটারি ইনজেকশন দিয়ে দুধের পরিমাণ বাড়ানো হয়। ইদানিং দুধ সংগ্রহে আর গাভী লাগে না। ছানার পানির সঙ্গে কেমিক্যাল মিশিয়ে সহজেই দুধ তৈরি করা যায়। দীর্ঘ সময় সতেজ রাখতে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। পানি গরম করে তাতে অ্যারারুট মিশিয়ে সহজেই নকল দুধ তৈরি করছে। হোমমেড রসগোল্লাও বিষেভরা।বাজার থেকে মানুষ প্রতিদিন টাটকা ও তাজা শাকসবজি নয়, টাকা দিয়ে টাটকা বিষ কিনে আনেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার কারণে খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে। যা রান্নার পরেও দূর হয় না। তাছাড়া সবজি বাজারে সবজি টাটকা ও তাজা দেখানোর জন্য কৃষক থেকে খুচরা বিক্রেতা সকলে কপার সালফেট মেশানো পানিতে ডুবিয়ে রাখে।
অন্যদিকে ভিটামিন ও পুষ্টির চাহিদা মেটাতেও মানুষ ফলমূলের নামে মূলত বিষ’ই খান। কারণ ফল পাকাতে ব্যবহার করা হয় কারবাইট আর দীর্ঘসময় সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয় ফরমালিন। ফল গাছে আসা থেকে বিক্রি পর্যন্ত মেশানো নয় কীটনাশক। তথ্য বলছে ক্রেতার ঘরে যাওয়ার আগে ৬ বার বিষ মেশানো হয়। লাল রঙ না হলে তরমুজ কিনতে অনেকের মন চায় না। কিন্তু তরমুজের সেই গাঢ় লাল রঙ আনতে সিরিঞ্জ দিয়ে তরমুজে দেওয়া হয় তরল পার ম্যাংগানেট। আর আম, কাঁঠাল ও কলা পাকাতে ব্যবহার করা হয় কারবাইড।
ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের কারণেই ফলগুলো রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। অতিরিক্ত তাপে ক্যালসিয়াম র্কাবাইড মেশানে আম ক্যালসিয়াম সায়নাইডে পরিণত হয়। যা আরো মারাত্মক বিষ। মুখরোচক খাবারে কার্বাইড, ইন্ডাসট্রিয়াল রঙ, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়।
বাজার থেকে মানুষ যে মাছ বাসায় আনেন তাতেও মেশানো হয় ফরমালিন ও ইউরিয়া। মাছ তাজা রাখতে ব্যবহার করা হয় কেমিক্যাল। মাছ চাষে ব্যবহার করা হয় মুরগির বিষ্টা। মুরগি খাবেন তাতেও শান্তি নেই। মুরগির খাবারে আর্সেনিক মেশানো হয়। দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়।
মসলায় মেশানো হচ্ছে রঙ, ইট ও কাঠের গুঁড়া। হলুদে ব্যবহার করা হয় লেড ক্রোমেট বা লেড আয়োডেড। আর মানুষ মজা করে যে মুড়ি খান তাতে মেশানো হচ্ছে ইউরিয়া।
জানাগেছে, বেকারিগুলো নোংরা পরিবেশে কেক-ব্রেড-বিস্কুট তৈরি করে। উৎপাদন খরচ কমাতে ভেজাল আটা, ময়দা, ডালডা, তেল, পচা ডিম ব্যবহার করে। কেক ও ব্রেড তৈরির জন্য সেখানে পিপারমেন্ট, সোডা ও ব্রেকিং পাউডার দেয়। খাদ্যদ্রব্য সতেজ রাখতে ট্যালো, ফ্যাটি এসিড ও ইমউসাইল্টিং, টেক্সটাইল রঙসহ নানা কেমিক্যালও করে। আর এনার্জি ড্রিং ও জুস কারখানায় অটো মেশিনে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা থাকলেও তা চালানো হচ্ছে হাতুড়ে পদ্ধতিতে। সব বাদ দিয়ে মানুষ যদি কেবল পানি খেয়ে বাঁচতে চান, শহরের মানুষ তাও পারবেন না। কারণ পুকুর ডোবা এবং ওয়াসার পানি বিশুদ্ধকরণ ছাড়া বোতলজাত করেই বিশুদ্ধ মিনারেল পানি বলে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে মানুষ প্রতিদিন বিশ পান করছেন। আর দানবের দল মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিয়ে কেবল মুনাফার নেশায় নীরব হত্যার খেলায় মেতে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে মেশানো ফরমালিনে ফুসফুস ও গলবিল এলাকায় ক্যান্সার হয়। টেক্সটাইল কালারগুলো খাদ্য-পানীয়তে মিশে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজ করছে। কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে আমাদের লিভার, কিডনি, হৃৎপি- ও অস্থিমজ্জা। ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা ও বৃদ্ধদের নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি। তরুণদের কিছুটা দেরিতে। খাদ্যপণ্য ভেজালের কারণেই দেশে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি বেড়ে যাচ্ছে।
কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেটাল বেইজড ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। এর ফলে কিডনি, লিভার ফাংশন, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে ঝুঁকি বাড়ছে। বমি, মাথাব্যথা, অরুচি, উচ্চরক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক রোগী বাড়ছে এসব কারণে। কপার সবজিতে মেশানো সালফেট লিভারের মারাত্মক ক্ষতি করে। ভেজাল মসলা ড্যামেজ করছে পাকস্থলি। ইউরিয়া মেশানো মুড়ি আর মাছ খেয়ে নষ্ট হচ্ছে কিডনি। লেড মেশানো হলুদের গুঁড়ায় হয় ক্যান্সার। মেটালিক ইয়েলো চোখের ক্ষতি করছে। কীটনাশকের কারণে বাড়ছে অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ।
এভাবে খাবারে ভেজাল এখন আর গোপনীয় ব্যাপার নয়। মহাসমারোহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যে বিষাক্ত পদার্থ মেশানো হচ্ছে। সবচেয়ে আলোচিত ‘ফরমালিন’। এটি মূলত জীবাণুনাশক ও প্রাণীর মরদেহ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হয়। ব্যাকটেরিয়া নাশক হওয়ায় কসমেটিক তৈরিতেও এটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাজারের ৮৫ শতাংশ মাছেই বরফের সঙ্গে বিষাক্ত ফরমালিন মেশানো হচ্ছে। মেশানো হচ্ছে শাকসবজি ও ফলমূলে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বর্ণনায়, ফরমালিন ব্যবহারে মানুষের দেহে পাকস্থলী ক্যান্সার, দৈহিক বিকলাঙ্গতা এমনকি প্রাণহানিও ঘটাতে পারে।
তাই পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এ পরিস্থিতির মধ্যেই পালিত হলো নিরাপদ খাদ্য দিবস। কিন্তু পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর আইনের প্রয়োগ দরকার হলেও ৮ বছর আগে কার্যকর হওয়া আইনের আজো তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না। এত এত প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ ও আইন থাকার পরেও খাদ্যে ভেজাল মেশানো চক্র প্রকাশ্যে খাবারে বিষ মেশাচ্ছে। ’৭৪-এর বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ) এর ১(ঙ) অনুযায়ী খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছর কারাদ-ের বিধান রয়েছে। ভেজালের বিরুদ্ধে রয়েছে ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এবং ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫। তার পরেও কেন খাদ্যে ভেজাল মেশানো হচ্ছে অহরোহ-এ প্রশ্নের জবাব পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। তাই নীরবে মানছেন সবকিছু। জীবন-মৃত্যু সাথে লড়ছেন জীবন সংসারে।