।। কামরূল আহসান ।।
অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার সংগ্রাম অব্যাহত রাখা, জনজীবনের সঙ্কট, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের লড়াইকে এগিয়ে নিতে, শোষণহীন, বৈষম্যমুক্ত ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ বদলে কাঙ্খিত গণমানুষের সংগ্রামের সাথী থাকবে ‘নতুন কথা’।
৪২-এ পা দিল ‘নতুন কথা’। এখন আর সে শৈশবে নেই। বয়সের পূর্ণতা ও অভিজ্ঞতায় অনেক সমৃদ্ধ। এটি আনন্দ এবং সুখের বিষয়। আগেই বলেছি সেই ১৯৮০ সালে আত্মপ্রকাশের পর দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়েছে এই সাপ্তাহিকীটি। কোনো বিনোদন নয়, সমাজের অবহেলিত, নিপিড়ীত ও বঞ্চিত গণমানুষের মুখপত্র হিসেবেই নিজেকে জনগণের কাছে তুলে ধরছে বিগত ৪১ বছর ধরে। এই পথ চলা কঠিন এক অভিযাত্রা। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে কঠিন বাস্তবতার মধ্যেদিয়ে যেতে হচ্ছে গণমানুষের খবরের এই গণমাধ্যমটিকে।
শতাব্দী পরে পৃথিবী আবার এক নতুন মহামারীতে আক্রান্ত। কভিড-১৯ নামের করোনা ভাইরাস পৃথিবীর স্বাভাবিকতাকে তছনছ করে দিয়েছে। এই মহামারি এখন পর্যন্ত এগারো কোটি মানুষকে আক্রান্ত করেছে, প্রায় চব্বিশ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলমান সময়ে গত ডিসেম্বরে করোনা আক্রান্ত হয়ে আমিও হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। হাসপাতালের বিছানায় সময় থমকে দাঁড়ায়। সেই সময়ে হাতের স্মার্ট ফোন হয়েছে গুরুত্বপুর্ণ সঙ্গী। সেই ফোন সেটের কল্যাণে ‘নতুন কথার’ অনলাইন ভার্সন প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
বর্ষপূর্তি সংখ্যার জন্য একটা লেখা দেয়া আমার আগ্রহের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। কারণ ‘নতুন কথা’র পথ চলার এক পর্যায়ে এর সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। তাই এই সাপ্তাহিক টি আমার আবেগে স্থান করে আছে। এবারও যখন নতুন কথা’র বার্তা সম্পাদক প্রিয় অনুজ মুক্তার হোসেন নাহিদ বর্ষপুর্তি সংখ্যায় লেখা দেয়ার জন্য বললো, তখন পুরোনো কিছু লেখার অংশ থেকে নিয়ে জুড়ে এই লেখা লিখলাম। আশাকরি লেখার পুনরাবৃত্তিতে পাঠকরা বিরক্ত হবেন না।
বর্তমান সময়ে পত্রিকা প্রকাশ করা এক কঠিন কাজ। প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান না হলে এটা সম্ভব নয়। সমাজের ধনীকশ্রেণী এখন নানা রকম পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের রয়েছে একাধিক সংবাদ মাধ্যম। বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নির্ভর এ সকল পত্রিকা ক্ষমতা কেন্দ্রীক স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে কাজ করে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সংবাদ পরিবেশনেও এদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে। এসকল গণমাধ্যম মূলত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তথা ধনিক, বণিক বুর্জোয়া সমাজের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত। তাই জনজীবনের সঙ্কট, সাধারণ মানুষের জীবন প্রবাহ শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের জীবন চিত্র এদের নিয়ন্ত্রিত গনমাধ্যমে ঠাঁই পায় না।
এখন দৈনিক পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রদান করে। অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থাও গড়ে উঠেছে। আশির দশকে আজকের মত এত বিজ্ঞাপন ছিল না। সরকারি সংস্থা ‘ডিএফপি’ (ডিপার্টমেন্ট অফ ফ্লিম এন্ড পাবলিকেশন) নামক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ইঞ্চিমাপা সরকারি বিজ্ঞাপনই ছিল প্রধান সম্বল। এতে কিছু অর্থের যোগান হতো। বাকী টাকা সংগ্রহ করতেন ‘মেনন ভাই’। সেই টাকায় পত্রিকা ছাপা, অফিস ভাড়া, সম্পাদক, প্রদায়ক, কন্ট্রিবিউটর ও ষ্টাফদের বেতন; সম্মানী পরিশোধের পরও বকেয়া জমতো। এখন হয়তো কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ‘নতুন কথায়’ ইঞ্চিমাপা সরকারি বিজ্ঞাপন এখন দেখি না। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন এখন কিছু দেখা যায়। তবে নতুন কথা’র নিজস্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনা এখনো ভিত্তির উপর দাঁড়ায়নি বলে মনে হয়।
‘নতুন কথার’ শুরুতে নিয়মিত লিখতেন কমরেড আমল সেন, হায়দার আকবর খান রনো। রাশেদ খান মেনন, শ্রমিক নেতা নাসিম আলী, সাংবাদিক শুভ রহমান, আবেদ খান, মোজাম্মেল হোসেন মন্টুসহ অনেকেই। পরবর্তীতে সাংবাদিক মতিউর রহমান, দিলীপ দেবনাথ, আশ্রাফ খানসহ অনেকেই। সাইফুল ইসলাম তালুকদার নিয়মিত কন্ট্রিবিউট করতেন, তিনি একই সাথে ছিলেন একজন পেশাদার প্রুফরিডার।
পত্রিকার শুরুতে নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন জনাব শামসুল হুদা, পরবর্তীতে পরেশচন্দ্র সাহা। মাহবুব আলম সেই সময় প্রধান প্রদায়ক হিসেবে ছিলেন। এছাড়াও রিপোর্টার হিসেবে রবিউল আলম, মেজবাহউদ্দি আহমেদ, আবুল হোসাইনসহ অনেকেই ছিলেন। মুফতি মুনির নামের দৈনিক সংবাদেও একজন পেশাদার ফোটোগ্রাফার নিয়মিত ছবি সরবরাহ করতেন ‘নতুন কথা’র জন্য।
তথ্য প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন প্রকাশনা শিল্পের চরম বিকাশ ঘটিয়েছে। পত্রিকা প্রকাশেও এর নিবিড় ছোঁয়া লেগেছে। ‘নতুন কথা’ও এর বাইরে থাকতে পারে নি। নব্বই দশকের শেষ দিকে পত্রিকার টাইপিং পদ্ধতি ‘লিডফন্ট’ থেকে কম্পিউটার টাইপিংয়ে উন্নয়ন ঘটানো হয়। এখন পেজ ‘মেক-আপ’ থেকে শুরু করে প্রচ্ছদ তৈরী সবকিছুই কম্পিউটারে করা হয়। ফলে খুব দ্রুতই সব সম্পাদনা করা যায়। পত্রিকা প্রকাশের এই আধুনিক বিকাশ চলমান। ‘নতুন কথা’ও তার ‘ওয়েবপোর্টাল’ তৈরী করেছে। সেখানে এখন পত্রিকাটি পড়া যায়।
তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ ধারায় ‘কাগজে’ প্রকাশিত পত্রিকা বিলিন হওয়ার মুখে। এখন পত্রিকা গুলোর ‘অনলাইন সংস্করণ’ প্রকাশিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক বিখ্যাত পত্রিকা তাদের কাগজের ‘সংস্করণ’ প্রকাশ বন্ধ করে দিয়ে ‘অনলাইন’ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করেছে। অদূর ভবিষ্যতে এদেশেও সেই পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গণমানুষের কথা বলার মাধ্যমকেও প্রস্তুত হতে হবে।
‘নতুন কথা’ প্রকাশে যুক্ত কর্মী বাহিনী, এর গ্রাহক ও পাঠক যারা তাদের বেশীর ভাগই রাজনৈতিক সচেতন ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ। পত্রিকার লাইফ লাইন হচ্ছেন তারা। তবে একটা প্রশ্ন ভাবনা আসে। এখন দলের কর্মীরা সবাই কি ‘নতুন কথা’ কেনেন বা পড়েন। কারণ পত্রিকার কোনো লেখা নিয়ে কোনো মন্তব্য বা আলোচনা করতে কাউকে দেখি না। আগে পত্রিকার যেকোনো লেখা নিয়ে তাদের সমালোচনা পত্রিকার মান উন্নয়নে সাহায্য করেছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ‘ফেসবুক’ এর জমানায় সকলের মনোনিবেশ সেখানেই নিবিষ্ট। ‘এন্ড্রয়েড’ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট’ ফোন যেন মানুষের ‘তথ্যযোগের’ মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের এক ব্যপক অংশ এতে মোহাবিষ্ট। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার’ এ জমানায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা ভবিষ্যৎই হয়তো নির্ধারণ করবে।
‘নতুন কথা’ গত ৪১ বছরে একটি প্রগতিশীল সাপ্তাহিক হিসেবে তার নিজস্ব ইমেজ তৈরী করেছে। ‘নতুন কথা’র ‘লোগো’ থেকে নিউজ আইটেম একটা ভিন্ন ধারার ব্রান্ড। পত্রিকাটি হাতে নিলেই বুঝা যায় এটার চরিত্র ও বৈশিষ্ট ভিন্ন ধর্মী। নিছক কোনো চটকদারী বা চটুল কোনো সংবাদ প্রকাশ এর নীতি মালার পরিপন্থী। ৪১ বছর পূর্বে গণমানুষের কাছে বাস্তবতার নিরীখে আসল সত্য তুলে ধরার প্রয়াসী ভূমিকা নিয়েছিল, আজো তা ‘নতুন কথা’র অবলম্বন। নতুন কথা তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই হটকারি, মিথ্যে ও ভূল তথ্য সম্বলিত যেকোনো সংবাদ, লেখা প্রকাশে নিবৃত থেকেছে। জনজীবনের প্রকৃত চিত্র সাহসের সাথে ‘নতুন কথা’ জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে এবং তা রাখবেও।
‘নতুন কথার’ ৪২ বছরে পা রাখার এই শুভক্ষণে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাদের সাহসী ভূমিকা ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রতি অভিবাদন জানাই। দীর্ঘ এ সময়কালে যে সাহসী কলম সৈনিকরা ‘নতুন কথা’ সৃষ্টি করেছে আজকের বাস্তবতায় তাকে এগিয়ে নেয়ার পথ রচনা ও লালন করা জরুরি কর্তব্য। এবং ‘নতুন কথা’র সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি এর সুহৃদদের একে রক্ষা ও প্রকাশনা অব্যাহত রাখার জন্য ভূমিকা রাখতে হব্।ে সকলের আন্তরিক সহায়তা ও সমর্থনে সকল সীমাবদ্ধতা ডিঙ্গিয়ে ‘নতুন কথা’ সামনে এগিয়ে যাবে।
প্রত্যাশা ব্যক্ত করি, অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার সংগ্রাম অব্যাহত রাখা, জনজীবনের সঙ্কট, শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের লড়াইকে এগিয়ে নিতে, শোষণহীন, বৈষম্যমুক্ত ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ বদলে কাক্সিক্ষত গণমানুষের সংগ্রামের সাথী থাকবে ‘নতুন কথা’। পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশের সাথে যারা যুক্ত তাদের সাহসী ও নিবেদিত কর্মপ্রয়াসকে অভিনন্দন জানাই। ‘নতুন কথা’ টিকে থাকুক গণমানুষের গণ আকাক্সক্ষার ধারক হয়ে।
লেখক: পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।