বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত কার্ল মার্কসের ২০২তম জন্মবার্ষিকীতে বিপ্লবী অভিবাদন
।। আব্দুর রউফ ।।
৫ মে ছিল বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মহান দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্ল মার্কসের ২০২তম জন্মবার্ষিকী। মানব সভ্যতা ও সমাজ বিকাশের ইতিহাসে মার্কস ছিলেন মুক্তির দিশারী। আর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্ব ও ‘পুঁজি’ গ্রন্থ শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রামের দিশা দিয়েছে। কাঁপিয়ে তুলেছে পুঁজিবাদী শাসকদের। আজো পৃথিবীতে পুঁজিবাদী শোষণ চলছে, চলছে শ্রমিক নির্যাতন ও বঞ্চনা। ফলে এখনো কার্ল মার্কস প্রাসঙ্গিক।
প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থার উন্নতি ও অগ্রগতির কারিগর শ্রমজীবি মানুষ। যাদের পরিশ্রমের ফসল আজকের আধুনিক সমাজ। তবে আমরা যে বিদ্যমান সমাজ দেখছি তা পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হইছে। এখন অধিকাংশ দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চর্চা বিদ্যমান। এটি এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে বাজার অর্থনীতি সৃষ্টি করা হয় কেবল মুনাফার জন্য। এ ব্যবস্থায় শিল্প-কারখানা ও উৎপাদনের উপকরণ সমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে ব্যক্তি মালিকানার।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটটা এসেছে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। ধাপগুলো হলো আদিম সাম্যবাদ, দাস ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। তারপর আসে পুঁজিবাদী সমাজ। মূলত বণিক শ্রেণীর হাত ধরেই এই ব্যবস্থার পথ চলা শুরু। আদিম সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই শুরু হলো বৈষম্য। আর উৎপাদিত সম্পদ ব্যক্তি মালিকানার অধীনস্থ হওয়ার পর থেকেই মূলত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন শুরু। আদিম সমাজ ব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় আসতে প্রয়োজন হয়েছে শ্রম শক্তি ও উৎপাদন শক্তি। এর ওপর নির্ভর করে সমাজের অগ্রগতি। আর শ্রম শক্তি ও উৎপাদন শক্তির সাথে জড়িত মালিক শ্রেণী। যারা শ্রমশক্তির মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে মুনাফা অর্জন করে। কিন্তু শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে। বৈষম্য থেকেই মালিক শ্রমিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি। সূচনা বিদ্রোহের। জীবনের নিরাপত্তা, কাজের পরিবেশ, বেতন-ভাতা ও নানা দাবিতে শ্রমিকদের সাথে মালিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় গড়ে উঠেছে নানা সংস্থা ও সংগঠন। উৎপাদন ব্যবস্থার প্রচলনের পর থেকেই এরা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে। নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বহু শ্রমিক নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৮৭৭ সালে ন্যায্য মজুরি, কাজের সময় ৮ ঘন্টা নির্ধারণ ও অন্যান্য দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছে। সেই আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১১ হাজার ৫৬২টি শিল্প-কলকারখানাসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সেইদিন শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় জনসমুদ্রে। প্রায় তিন লক্ষ শ্রমিক কাজ বাদ দিয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। সে আন্দোলন দমানোর জন্য বিনা উস্কানিতে পুলিশ নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। নিহত হন ১০ জন শ্রমিক নিহত। পুলিশের এমন বর্বরতার পরেও শ্রমিকদের আন্দোলন দমানো যায় নি। অবশেষে শ্রমিকরা জয়ী হন।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় যেহেতু মুনাফা অর্জন থাকে মালিকদের মুখ্য উদ্দেশ্য, তাই শ্রমিকের অধিকার ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার প্রতি মালিকের গুরুত্ব থাকে না। দেশে প্রায় সময় বিভিন্ন কল-কারখানায় বেতন ভাতার জন্য শ্রমিকদের অন্দোলন লক্ষ করা যায়। যৌক্তিক দাবি হওয়া সত্বেও বেতন ভাতা প্রদানের কারখানার মালিকেরা তালবাহানা করে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রাপ্য মুজুরি চাওয়ার অপরাধে নিরপরাধ শ্রমিকদের অমানবিক নির্যাতন বা হত্যার মত ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে শ্রমিক হত্যা করা হয়। আবার শিল্প-কারখানায় মালিকদের গাফিলতির কারণে ঘটছে বড় দুর্ঘটনা। রানা প্লাজা ভবন ধসে সহ¯্রাধিক শ্রমিক নিহত হন। আহত হন হাজারো শ্রমিক। সাভারের আরো দুটি কারখানা ধসের ঘটনায় ৬২ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। আশুলিয়ার তাজরীন গার্মেন্টসের ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে মারা যান প্রায় ১০০ জন শ্রমিক। এছাড়া নানা দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই। অন্যদিকে তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ যৌন হয়রানি হন। মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ৭১ ভাগের বেশি। শ্রমিকদের নিরাপত্তায় তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। নেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। বাংলাদেশের শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শ্রম আইন আছে। কিন্তু বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী মালিক শ্রেণি শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ও নিরাপত্তা দেন না। শ্রম আইন-২০০৬ এর অধীনে ৫ নং ধারা অনুযায়ী কোনো শ্রমিক কোনো কারখানায় বা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিতে নিয়োগ হলে নিয়োগপত্র ও পরিচয় পত্র পাওয়ার অধিকার রাখে। ১০৩ নং ধরা অনুযায়ী একজন শ্রমিক সপ্তাহে প্রতিষ্ঠান ভেদে একদিন বা দেড়দিন ছুটি ভোগ করতে পারবেন। শ্রম আইনের ১১৫ নং ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক প্রতি পুঞ্জিকা পূর্ণ মজুরিতে দশদিনের নৈমিত্তিক ছুটি ঘোষণা করতে হবে। ১১৬ নং ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি ১ বছরে পূর্ণ মজুরিতে অসুস্থজনিত কারণে ১৪ দিনের ছুটি পাওয়ার অধিকার রাখে। এই ছুটির জন্য মালিক কোনো প্রকার মজুরি কর্তন করতে পারবে না। সেই সাথে ১১৭ নং ধারায় বলা হয়েছে চাকুরির ১ বছর পূর্ণ হলে প্রতিষ্ঠান ভেদে আঠারো দিনে একদিন, বাইশদিন কাজের জন্য একদিন, এগারোদিন কাজের জন্য একদিন মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি পাওয়া আইনগত অধিকার রাখে একজন শ্রমিক। এই আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী একজন মহিলা শ্রমিক সন্তান জন্মদানের আগের আট সপ্তাহ ও পরের আট সপ্তাহ প্রসূতিকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকার রাখে। এই আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী একজন মালিক বিনা কারণে শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করতে পারবে। তবে শর্ত হলো মালিককে ১২০ দিনের মজুরি বা ১২০ দিনের নোটিশ দিয়ে শ্রমিককে বিদায় দিবেন। আইনে এমনটি থাকলেও বিনা নোটিশে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার বহু উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে বহু শ্রমিককে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। শ্রম আইনের ৩৪ ধারা মোতাবেক বাংলাদেশে শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য আইন কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না। যার ফলে প্রতিনিয়ত সর্বক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কর্তৃক আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিকদের জন্য গৃহীত কিছু পদক্ষেপ বাংলাদেশ গ্রহণ করলেও সেই অনুযায়ী দেশের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করা হয় না।
এভাবে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা যতদিন থাকবে শ্রমিক শ্রেণি লাঞ্চনা-বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হতেই থাকবে। এর জন্য প্রয়োজন শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র। কার্ল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে শ্রমিক শ্রেণির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তবেই শ্রমজীবি মানুষের মুক্তি মিলবে। আর সেই সমাজ প্রতিষ্ঠায় গরিব মেহনতী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সংগ্রামের প্রেরণা মার্কসবাদ। মার্কসবাদকে আকড়ে ধরে পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিক শ্রেণী তাদের ন্যায্য অধিকার বুঝে পাক। ধনী গরিবের বৈষম্যহীন এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠুক মার্কস-এর জন্মদিনে সেটাই প্রত্যাশা। দুনিয়ার মজদুর এক হও।
লেখকঃ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।