॥ সৈয়দ আমিরুজ্জামান ॥
ভারতবর্ষে কবে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট বলা না গেলেও ‘সমাচার দর্পণ’কে প্রথম বাংলা পত্রিকা হিসেবে ধরা হয়। যা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮১৮ সালের ২৩ মে। এ বছর বাংলা পত্রিকার ২০৩ বছর অতিবাহিত হলো। শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’-এর উদ্যোক্তা ছিলেন জশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড। আর জন ক্লার্ক মার্শম্যান ছিলেন সম্পাদক। দাম ছিল চার আনা। তারও চার দশক আগেই ভারতবর্ষে আধুনিক সংবাদপত্রের সূচনা ঘটে ১৭৮০ সালে। ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে ইংরেজি সাপ্তাহিকটি বের করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। ১৮১৮ সাল পর্যন্ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত সব পত্রিকা ছিল ইংরেজি এবং ইউরোপীয়দের দ্বারা সম্পাদিত। ১৮১৮ সালে জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত ‘দিগদর্শন’ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম মাসিক পত্রিকা। এর ইংরেজি সংস্করণের নাম ‘ম্যাগাজিন ফর ইন্ডিয়ান ইয়ুথ’। ওই বছর গঙ্গাকিশোর ও হরচন্দ্র সম্পাদিত বাঙালি নিয়ন্ত্রিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেট’ প্রকাশিত হলেও এর কোনো কপি পাওয়া যায় নি বলে তার সঠিক প্রকাশ-তারিখ জানা যায় না। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১) প্রথম সাহিত্যপত্রিকা। তিনি সংবাদ রত্নাবলী (১৮৩২), পাষণ্ড পীড়ন (১৮৪৬) ও সংবাদ সাধুরঞ্জন (১৮৪৭) নামে আরো তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৩১ সালে মুসলিম সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা সমাচার সভারাজেন্দ্র বের হয় শেখ আলিমুল্লাহ’র সম্পাদনায়। অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পদনায় ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। ১৮৪৬ সালে মৌলভী ফরিদুদ্দীন খাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত জগদুদ্দীপক ভাস্কর নামের সাপ্তাহিকটি ছিল পঞ্চভাষিক। নারীদের জন্য প্রথম সাময়িকী মাসিক পত্রিকা (১৮৫৪) বের করেন প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাধ শিকদার।
কুণ্ডির জমিদার কালীচরণ চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতা এবং গুরুচরণ রায়ের সম্পাদনায় পূর্ববাংলার প্রথম পত্রিকা রংপুর বার্তাবহ (১৮৪৭)। ঢাকার প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ’ আলেকজান্ডার ফর্বেসের সম্পাদনায় বের হয় ১৮৫৬ সালে। ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত সোমপ্রকাশ থেকে সমাজ-রাজনীতি ছাপা হতে থাকে। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় বাবুবাজারের ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ থেকে ঢাকার প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’ (১৮৬১) বের হয়। কুষ্টিয়ার কাঙাল হরিনাথ ১৮৬৩ সালে মাসিক ‘গ্রামবার্তা’ বের করেন। এ ছাড়া পূর্ববাংলায় নিয়মিত প্রকাশিত সংবাদপত্রের মধ্যে ছিল ই. সি. কেম্পের বেঙ্গল টাইমস (১৮৭১) ও কালীপ্রসন্ন ঘোষের বান্ধব (১৮৭৪)। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্গদর্শন (১৮৭২)। ১৮৭৭ সালে ঠাকুর-পরিবারের উদ্যোগে বের হয় মাসিক ভারতী। সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বর্ণকুমারী দেবী। এই পরিবারের সম্পাদনায় প্রকাশিত আরো দুটি পত্রিকা বালক (১৮৮৫) ও সাধনা (১৮৯১)। ১৮৯১ সালে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় বের হয় সাপ্তাহিক হিতবাদী। ১৮৯৪ থেকে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে’র মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা। মীর মোশাররফ হোসেনের মাসিকপত্র আজীজন নেহার (১৮৭৪) ও পাক্ষিকপত্র হিতকরী (১৮৯০)। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয় সৈয়দ এমদাদ আলীর সম্পাদনায় মাসিক সাহিত্যপত্র নবনূর। একই বছর কলকাতা থেকে বের হয় মোহাম্মদ আকরম খাঁর মাসিক মোহাম্মদী। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর সম্পাদনায় ছোটদের মাসিক পত্রিকা সন্দেশ বের হয় ১৯১৩ সালে। প্রমথ চৌধুরীর মাসিক সবুজপত্র হলো চলিতরীতির প্রথম পত্রিকা। ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন বের করেন মাসিক সওগাত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সম্পাদনায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকাও এই বছর প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও আবদুর রশীদ সিদ্দিকীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক সাধনা। মোজাম্মেল হক ১৯২০ সালে প্রকাশ করেন মোসলেম ভারত। কাজী নজরুল ইসলামের পত্রিকার মধ্যে রয়েছে নবযুগ, লাঙল ও ধূমকেতু। মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে সম্পাদনা করেন নবযুগ (১৯২০)। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট প্রকাশ করেন অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু। সাপ্তাহিক লাঙল (১৯২৫) প্রকাশিত হয় ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সম্প্রদায়ের মুখপত্র’ হিসেবে। লাঙল পরে মোজফ্ফর আহমদের গণবাণী (১৯২৬)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলা সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে কল্লোল (১৯২৩)। সম্পাদক ছিলেন দীনেশচন্দ্র দাস। এর পরের বছর প্রকাশিত সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন যোগানন্দ দাস। সমকালীন আরেকটি পত্রিকা মাসিক কালিকলম (১৯২৬)। ১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি আবুল হুসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। শিখা (১৯২৭) ছিল এই সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র। ’৪৭-এ দেশভাগের পর পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক পয়গাম। সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী। একই সময়ে প্রকাশনা শুরু হয় জিন্দেগী নামের অর্ধসাপ্তাহিকের। মওলানা আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ তখন কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসে। দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৪৯ থেকে এবং দৈনিক সংবাদ ১৯৫১ থেকে ছাপা হতে থাকে। এই দুটি পত্রিকা দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানে ছিল।
লেখকঃ সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা।